অয়ন্তিকা কলকাতার একটি
নামী স্কুলের ছাত্রী। তার এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। এতক্ষণ অন্য
বন্ধুরা কেউ গান কেউ মাউথ অর্গান নিয়ে আনন্দ করছিল, সে আসতেই, সকলের চোখ ঘুরে গেল
তার দিকে। কিছুদিন আগেই বন্ধুরা জেনেছে, এই বাচ্চাটি তাদের মতো এলেবেলে নয়।
দিনকয়েক আগে ওর মধ্যমস্তিষ্ক জেগে উঠেছে। কোনো একটি সংস্থা থেকে মিড ব্রেইন অ্যাক্টিভ
করার যে কোর্স করাচ্ছে, সেই কোর্সে ভর্তি হয়ে এখন দিব্যচক্ষু গেছে খুলে। চোখ বাঁধা
অবস্থায় দিব্যি বলে দিচ্ছে স্কেচ পেনের রঙ, বইয়ের পাতার সংখ্যা, এমনকি বই পড়েও
দিচ্ছে গড়গড় করে। স্কুলে মাঝারি মানের পড়াশোনা করা বাচ্চাটি হঠাৎ কী করে এমন বদলে
গেল, রহস্যটা কী, কায়দা করে জেনে নিতে হবে বলে ভেবে রেখেছিলেন বাকি বাবা মায়েরা।
সে আসতেই শুরু হল কৌতুহলী প্রশ্ন।
সায়েন্স ফিকশন নয়, কল্পবিজ্ঞানের গল্পও নয়।
ঘটনাটি খাস কলকাতার এবং এই বছরেরই। একটুও অবাক হবেননা। গত দু বছর থেকেই কলকাতার
বহু স্কুলে দু-চারটি এরকম বাচ্চা দেখা দিচ্ছিল যারা চোখ বাঁধা অবস্থায় জিনিসের রঙ
বলে দিচ্ছে বা বই খাতা পড়ে দিচ্ছে। এবছর শুরু হয়েছে জেলার মফস্বল শহরগুলিতে। মুর্শিদাবাদ,
নদীয়া, উত্তরচব্বিশ পরগণা জেলা ছেয়ে গেছে এরকম দিব্য চক্ষু খোলাবার সংস্থায়।
কারা এরা? সত্যিই কী দিব্যচোখ বলে কিছু আছে?
যদি আছে তা কী কেউ জাগ্রত করতে পারে? যদি পারে তাহলে কী উপায়ে তা সম্ভব?
বছর চারেক আগে মিড ব্রেন অ্যাক্টিভেশনের
কোর্স করিয়ে মুম্বই থেকে ব্যবসা জমানোর চেষ্টা করছিল 'মাইণ্ড টেক' নামের একটি সংস্থা। কোর্স ফী ছাত্র পিছু পঁচিশ হাজার। পশ্চিমভারতের পর তারা পাড়ি দিল
দক্ষিণ ভারত। সেখানে ম্যাঙ্গালোর এবং কোচিনের বিজ্ঞানকর্মীদের কাছে বাধা পেল। কিন্তু
দমে না গিয়ে তারা টার্গেট পয়েন্ট সরিয়ে নিয়ে এল কলকাতায়। বিজ্ঞাপন একটু পাল্টাতে
হল। শুধুমাত্র চোখ বাঁধার অলৌকিক ক্ষমতায় বাঙালী ভিজবেনা বুঝে এর সাথে যোগ হল আরও
পালিশ। যেসব শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠতে গড়িমসি করে তাদের জন্য প্যাকেজের মধ্যে এল
স্লিপিং অ্যাওয়েকনেস, একদিনে দুশো পাতা পড়ে ফেলার ক্ষমতার জন্য কোয়াণ্টাম রিডিং,
বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষা করে বাচ্চার ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য
ডার্মাটোগ্ল্যাফিক্স ইন্টেলিজেন্সি টেষ্ট। বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা এগুলোকে
অপবিজ্ঞান বা সিউডোসায়েন্সের তালিকায় নথিভুক্ত করলেও এটা মিডব্রেন বেওসায়ীরা এটা জানে
যে ভারত একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ, এখানে মাত্র এক শতাংশ মানুষকে এক টাকা করে
ঠকাতে পারলেই কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। কলকাতাতেও পরিবেশ তৈরিই ছিল। সেই ইংলিশ
মিডিয়াম স্কুলের বাচ্চা। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে চায়না, সারাদিনের
ইঁদুর দৌড়ে এক আধবার দুষ্টূমির সুযোগ খোঁজে। স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার সুযোগ না দিয়েই
বাবা মা তাদের বাচ্চাদের সব বিষয়েই ফার্স্ট করতে চান। পড়া, নাচ, ছবি, সাতার,
টেনিস, দাবা- সবেতেই অংশগ্রহণ করতে হবে। আর হ্যা, সবগুলোতেই ফার্স্টও হতে হবে।
প্রতিযোগিতা শুধু মাত্র ছাত্রদের মধ্যে নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও। ফ্ল্যাট কালচার,
বাড়িতে চতুর্থ জনের অনুপস্থিতি, অফিসের বাইরে বাবার কোনো অস্তিত্ব নেই, মায়ের গর্ব
শুধুমাত্র বাড়ির ফার্ণিচারে আর সন্তানে। হাঁস ফাস শুধু বাচ্চাটি করেনা, করছে বাবা
মায়েরাও। মেলাঙ্কলিক অবস্থা থেকেই অলৌকিকতার নতুন ভার্সানে বিশ্বাস। আর এই সুযোগকে
সুন্দরভাবে কাজে লাগাচ্ছে আগরওয়াল, কাপাডিয়ারা।
তো হল কী, সেই আগরওয়াল খুললেন এখানে কিছু
শাখা। একটি সালকিয়ায়। তারপর অন্যেরা একে একে গড়িয়াহাট, দমদম, গড়িয়া, হাওড়া। নিজেদের
মধ্যে বন্ধুত্বমুলক প্রতিযোগিতা। যদিও গড়িয়াহাটেরটিই এখনও সবার চেয়ে এগিয়ে। জেলা
গুলিতেও তারাই সবচেয়ে বেশি শাখা খুলতে পেরেছে।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি
ঘোষনা করেছেন বেসরকারি স্কুলগুলির অব্যবস্থায় লাগাম টানবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
স্কুলের অতিরিক্ত ফীজের দিকে নজর দিচ্ছেন। কিন্তু গোকুলে বাড়ছে যারা? গুগল খুললেই
যে সব সংস্থাগুলো মিড ব্রেন, স্মার্ট ব্রেন, শার্প মেমরির নামে পকেট কাটছে তাদের
কী হবে?
জাদুকর
জাদুর খেলা দেখান দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য। সেই খেলা দেখে আমরা বিস্মিত হলেও মনে
মনে এটা বিশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরি যে এতে অলৌকিক বলে কিছু নেই। আছে, বিশেষ কিছু কৌশল
যা সাধারণ মানুষও চেষ্টা করলে আয়ত্ত করতে পারে।
খুব
পুরোনো একটি জাদু কৌশল হল চোখ বেঁধে মোটরবাইক বা সাইকেল চালানো। গত শতকের বিশের
দশকে জাদুকর দুনিঙ্গার প্রায়শই চোখ বেঁধে গাড়ি চালিয়ে শপিংয়ে যেতেন। ডেভিড
বার্গেলস ১৯৫০ সালে একটি আস্ত উড়োজাহাজকেই চালালেন চোখ বাঁধা অবস্থায়। শুধু তাই
নয়, বিমানবন্দরে খুবই সূচারু হাতে সেটিকে অবতরণও করলেন। জেমস র্যাণ্ডিও একসময়ে
এরকমই একটি স্টাণ্টবাজি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার দু চোখের ওপরে দুটো
প্রমাণ সাইজের পিৎজাকে রেখে চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা হয়েছিল, তারপর একটা কালো দুই
স্তরের মোটা ব্যাগকে মাথায় পরিয়ে ব্যাগের মুখটি গলার কাছে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
গাড়ির পাশে সর্বক্ষণ ছিলেন একজন রিপোর্টার। যেদিকে যেদিকে রিপোর্টার যেতে
বলেছিলেন, র্যাণ্ডি নিউ জার্সি শহরের সেদিকেই গাড়ি ঘুরিয়েছিলেন অবলীলাক্রমে।
হায়দরাবাদের সরোজা রায়ও চোখ বেঁধে গাড়ি চালাতে পারতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে দুনিয়ার
ক্ষুদেতম ব্লাইণ্ডফোল্ড ম্যাজিশিয়ান হিসেবে নজর কাড়েন, পরে মাদ্রিদের বিশ্বম্যাজিক
প্রতিযোগিতায় যোগ দেন।
৬
ফেব্রুয়ারি ২০০২, টাইম ম্যাগাজিনের শিরোনামে এল নাতালিয়া লুলোভা নামের এক রাশিয়ার
বালিকা। লুলোভার পরিবার বছর তিনেক ধরেই আছে ব্রুকলিনে। টাইমের নিবন্ধকার একদিন
দেখলেন, ম্যানহাটন শহরের আইন দপ্তরের ফুটপাতে বসে একটি বছর দশের বাচ্চা মেয়ে মায়ের
কোলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। কারণ কিছুক্ষণ আগেই নাকি জেমস র্যাণ্ডির চ্যালেঞ্জের কাছে
তাকে গোহারা হতে হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এরকম যে, র্যাণ্ডির বহুদিনেরই ঘোষণা- কেউ যদি
কোনো অতীন্দ্রিয়, ঐশ্বরিক, অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিতে পারবে তাকে দেওয়া হবে দশ
লক্ষ ডলার পুরস্কার। তো, র্যাণ্ডির ঘোষণার কথা শুনে লুলোভার কোচ মার্ক কমিশারভ তাকে
নিয়ে এসেছিল ম্যানহাটনে। কমিশারভ নিজে একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হলেও লেনিনের
দেশে তার পরিচিতি একজন প্যারানর্মাল ক্ষমতা তৈরির কোচ হিসেবেই। নাতালিয়াকে তিনি
দীর্ঘদিন ধরে কোচিং করিয়েছেন কিভাবে চোখ বাঁধা অবস্থায় যেকোনো বস্তুকে শুধুমাত্র
ছুঁয়েই তার রং বলে দেওয়া যায়। এদিকে জেমস র্যাণ্ডি এডুকেশন্যাল ফাউণ্ডেশনের কর্মকর্তাদের চিড়ে শুকনো কথায় ভিজবে না। তাঁরাও
পুরস্কার দেবার আগে বাজিয়ে নেবেন সবদিক দিয়ে। তবেই না কয়েকদশক ধরে তাঁদের
চ্যালেঞ্জ অটুট আছে। তাঁরা প্রথমে নাতালিয়ার চোখে পরিয়ে দিলেন সাঁতারুদের চশমা।
চশমার সামনেটা মুড়ে দিলেন স্পঞ্জ এবং অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে। নাতালিয়া র্যাণ্ডিকে
অবাক করে দিয়ে ওই অবস্থায় পর পর বলে দিতে থাকল তাকে ছুঁতে দেওয়া বস্তুর রঙ। এটা
ওপেন চ্যালেঞ্জ। দর্শক হিসেবে হাজির ছিলেন বহু মানুষ। চ্যালেঞ্জের হারজিত
নির্ধারণের জন্য দু তরফেই একজন করে উকিল
বসে চেয়ারে। দর্শকদের হাততালিতে যখন হলঘর ফেটে পড়ছে তখন র্যাণ্ডি এই পরীক্ষাটিই
পূনর্বার করে দেখতে চাইলেন। এবারও নাতালিয়ার জিত হল। র্যাণ্ডি বুঝলেন তার
বোকামিটা কোথায়। দ্বিতীয় পরীক্ষা থামিয়ে নাতালিয়ার চশমার চারদিকে লাগিয়ে দিলেন
ইলেকট্রিক তার জোড়া দেওয়ার ব্ল্যাকটেপের মত একটি জিনিস। তিনি বিশেষ করে বোজাতে
চাইছিলেন নাক আর চোখের মাঝখানের কোনা মতো স্থানটি। স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলেন
নাতালিয়া কোনোভাবেই যেন চুলকোবার আছিলায় নাকে বা চোখে হাত না দেয়। ব্যাস। এখানেই
কেল্লা ফতে। টানা একঘণ্টা চেষ্টা করেও হাজার ছুঁয়েও নাতালিয়া একটি বস্তুরও রঙ বলে
দিতে পারেনি।
তবে এসব ব্যাপারে সবচেয়ে শোরগোল
ফেলেছিলেন বোধহয় ইউরি গেলার। পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ ১৮ অক্টোবর
১৯৭৪ আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণাগার ‘স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট’-এর
একটি রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই ইউরি চলে এলেন পৃথিবীর প্রায় সমস্ত
সংবাদপত্রের শিরোনামে। বলা বাহুল্য ভেড়ার পালের গল্প সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য।
ইউরি জন্মসূত্রে ইজরালীয়। তরুণ বয়সে
ছিলেন ইজরালীয় গুপ্তচর সার্ভিসে, পরে প্যারাশুট-সেনা বিভাগে। বাইশ বছর বয়সে
সেনাবাহিনী ছেড়ে যাদুকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। শিমসন শট্টাংকে সহকারী করেন। এই
দুজনে মিলে করতেন কী, শহরের সম্ভ্রান্ত বাড়ির পার্টিগুলিতে জাদু খেলা দেখাতেন।
সেখানে অন্যান্য জাদুর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল চোখ বাঁধার খেলাটি। দুজনের মধ্যে
একজনের চোখ বাঁধা থাকে, অন্যজন দর্শকদের কাছ থেকে একটি একটি করে জিনিস নিয়ে তুলতে
থাকেন, আর বাঁধা চোখের কাছ থেকে আসতে থাকে সঠিক বর্ণণা। এই জাদু দেখাতে দেখাতে
ইউরির অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দাবি যতই বাড়তে লাগল লণ্ডনের ম্যাজিক সার্কেল মনে করতে
লাগল ইউরি জাদুখেলায় অলৌকিকত্বের দাবি করে রীতিমতো অন্যায় কাজ করছেন। অবশেষে
ম্যাজিক সার্কেল ইউরির সদস্যপদ বাতিল করে দেয়।
লণ্ডন বাতিল করল তো কী হয়েছে। সু্যোগসন্ধানী
ইউরি একেবারেই কেয়ার করলেন না। বছর খানেকের মধ্যেই তার জীবনে এলেন মার্কিন ধণকুবের
ড অ্যানড্রিজা পুহারিক। পুহারিক একাধারে বিজ্ঞানী এবং অতীন্দ্রিয় শক্তির অস্তিত্ব
প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত প্রাণ। পুহারিকের অর্থ, প্রচার, বিজ্ঞানকে কাজে লাগালেন ইউরি।
এজন্য অনেক দেশের দূরদর্শনকে ম্যানেজ করে সেখানে অনুষ্ঠাণ করতে লাগলেন। সেসময়
ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্থার
হয়ে গবেষনার কাজ করত। আমেরিকা বরাবরই প্যারাসাইকোলোজিস্টদের আঁতুড়ঘর। সেখানেরই
কিছু প্যারাসাইকোলোজিস্ট কিছুদিন ধরেই ইউরির ওপর নজর রাখছিলেন। তারা এগিয়ে এসে
ইউরির অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার ওপর পরীক্ষা করার জন্য স্ট্যানফোর্ড রিসার্চের সাথে
চুক্তিবদ্ধ হন। প্যারাসাইকোলোজিস্ট এবং বিজ্ঞানী দুই সত্বাই আছে এমন দুজনকে
দায়িত্ব দেওয়া হল ইউরিকে পরীক্ষা করার জন্য। এদের মধ্যে একজন হলেন ড পুটহফ, অন্যজন
ড টার্গ। দুজনেরই তখন লেজাররশ্মির ওপর গবেষনা নিবন্ধ প্রকাশ হয়ে গেছে এবং বিজ্ঞানী
মহলে অল্পবিস্তর পরিচয়ও আছে। ঠিক এরকমই খুঁজছিলেন ইউরি।
তবে ইউরি গেলারের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার কথা
নেচার কখনই সমর্থনের সুরে প্রকাশ করেনি। তারা কেবলমাত্র স্ট্যানফোর্ড রিসার্চের
রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিল। এবং তাও গবেষনার দুবছর পরে। এমনকি নেচার এর সত্যতার
কোনোরূপ দায়িত্বও নেয়নি।
ইউরি তখন মধ্য গগনে। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার
প্রদর্শনে আরও মেতেছেন। চোখ বেঁধে বই পড়ে আর গাড়ি চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে
দিচ্ছেন। এমন সময়ে জেমস র্যাণ্ডি ইউরি গেলারের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে
বই লেখেন, ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ইউরি গেলার’। এই বইতে গেলারকে কোপ্তা কাবাব বানানো
হয়েছিল। ইউরি মামলা ঠুকে বসলেন র্যাণ্ডির বিরুদ্ধে। কোর্টে র্যাণ্ডি তাই তাই করে
দেখাতে সমর্থ হলেন যা যা ইউরি দেখান। ব্যাস। মামলায় ইউরির হার হল এবং কোর্টের রায়ে
র্যাণ্ডির মোকদ্দমা চালানোর পুরো খরচ আনা পয়সা হিসেবে মিটিয়ে দিতে হল তাকে। সেই
থেকে সংবাদ শিরোনামে ইউরিকে আর দেখা যায়না।
চোখ বাঁধা অবস্থায় শুধুমাত্র স্পর্শ করে
বলে দেওয়ার ক্ষমতার কথা প্যারাসাইকোলোজিস্টদের বইতে ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। সেই
দীর্ঘ তালিকায় ১৮২০ সালের ওয়াশিংটনের এক বিশপ যেমন আছেন, হাল আমলের ইতালির মাঝবয়সী
মহিলাও আছেন। প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনোরূপ বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা হয়নি, বা হলেও
সেই পরীক্ষার দশা হয়েছে ইউরির স্ট্যানফোর্ডের মতোই। কয়েকবছর আগে ইতালির এক
মধ্যবয়স্কা যিনি নিজেকে আর জি নামে জনপ্রিয় করে ফেলেছিলেন বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায়
ডাঁহা ফেল করলেন। পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানে তাকে পরীক্ষা করলেন দুজন
বিজ্ঞানী এবং একজন মনোবিদের একটি দল। একটি বাক্সের মধ্যে রাখা খামবন্ধ বস্তুগুলির
পরিচয় দিতে আর জি ব্যর্থ হলেন।
প্যারাসাইকোলোজিস্টদের মিথ্যে দাবিকে বাগে
আনতে বিজ্ঞানী মহলেও কেউ কেউ একটু আগ বাড়িয়েই চোখ বেঁধে দেখতে পাওয়ার বিষয়টিকে
পরীক্ষা করে দেখতে গেছেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা হতাশ। কেউ কালো কাপড়ের তলা
দিয়ে দেখছিল তো কেউ চোখের পটির তলা দিয়ে দেখছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বস্তুটির
গায়েই মসৃণতায় সূক্ষ পার্থক্য রাখা ছিল, অনেকটা অন্ধদের ব্রেইলি শিক্ষার মতো।
ব্লাইণ্ডফোল্ডের জাদুগুলো ইউরোপে এখন এতই
বেশি সহজলভ্য হয়ে গেছে যে প্রতিষ্ঠিত জাদুকরেরা এড়িয়ে চলেন। সেখানের ম্যাজিক
বাজারে মাত্র ২৫ ডলার খসিয়ে যে কেউ এই জাদু শিখে নিতে পারছেন।
আবার আসি ২০১৪ তে। মুম্বই থেকে দক্ষিণ
ভারত হয়ে কলকাতা এবং বাংলার জেলাগুলিতে এল ব্লাইণ্ডফোল্ড। কোর্সগুলিতে প্রথম কদিন
নাচা-গানা, গ্রুপ থেরাপি, মেডিটেশন শেখানোর পরই এক এক জন বাচ্চাকে তারা বেছে বেছে
শেখাচ্ছে চোখ বেঁধে দেখতে পাওয়ার কৌশল। প্রতিটি সংস্থা তাদের শাখা খুলছে মহকুমা
শহরেও। আকর্ষণীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি অফার আছে। শুধুমাত্র ঘর ভাড়া আর লোকাল ঝামেলা সামলে
নিলেই বাচ্চা পিছু কমিশনের ব্যবস্থা বজায় আছে। এভাবে কোর্স করে আসা বাচ্চাদের বেশ
কয়েকজনকে আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, চোখে মেরে দিয়েছি আঠালো পটি। ব্যাস, সবার
অলৌকিক ক্ষমতা মুহূর্তে ভ্যানিশ। মাস কয়েক ধরে বহু স্টেজে আমি ফাঁস করে চলেছি মিড
ব্রেনের কৌশল। আমার ছয় বছর বয়সী কন্যা চোখ বেঁধে আমার পার্টনার হচ্ছে।
এটা নিছক ম্যাজিক হলে নিশ্চয় কিছুই বলার
থাকত না। কিন্তু মিড ব্রেন অ্যাক্টিভ করে দেওয়ার নামে এরা যেটা করছে তা হল বিশুদ্ধ
প্রতারণা। বিজ্ঞান বলে, মস্তিষ্ককে ধার দেওয়ার কোনো শর্টকার্ট নেই। জন্টি রোডসের
ক্ষিপ্রতা, গাওস্করের ধৈর্য কিম্বা রিচার্ডসের ইনটিউশন- সবই এসেছে দীর্ঘদিনের কঠোর
অভ্যেস, পরিশ্রম আর নিয়মানুবর্তিতার পর। এর কোনো বিকল্প নেই। বাবা মায়েরা কবে
বুঝবেন পৃথিবীর কোনো কোর্সই তার বাচ্চাকে চোখ বেঁধে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা এনে দিতে
পারবেনা। এতে শুধু বাচ্চারা মিথ্যে বলা শিখছে। প্রথম দিকে তারা তার বাড়ির লোককে
মিথ্যে বলছে, পরে বলছে বন্ধুদের এবং অন্যদের। যে মিথ্যে মজা দিয়ে শুরু হচ্ছে, পরে
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আর কোনোদিনই সত্যি হচ্ছেনা। যতদিনে বাচ্চা ল্যাটেন্সি পিরিয়ড
থেকে সেকেণ্ডারি নার্সিস্টিক অবস্থায় পৌঁছবে, অভিভাবকদের আর কিছু করার থাকবেনা।
পকেট ফাঁকা তো হবেই, সাথে সাথে বাচ্চার বিশ্বাসযোগ্যতাও কমবে। কোর্সের ট্রেনার বা
ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকরাও বেপাত্তা হয়ে যাবে। চিটফাণ্ডের খুদে সংস্করণ দেখতে পাব
আমরা।
অভিভাবকেরা তখনও হয়তো বুঝবেননা স্লিপিং
অ্যাওকনেসের কোর্স করে নয়, বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠতে চায় কর্মব্যস্ত বাবা মায়েদের
নরম আঙ্গুলের ছোঁয়ায়, ঘুমোতে চায় ঠাকুরমার ঝুলি শুনে।
FOR YOUTUBE LINK-
https://www.youtube.com/watch?v=8tUbtHyYZl8&t=2s