Thursday, April 21, 2011

জাপানের পরমানু বিপর্যয়- বাস্তব টা কি?


জাপানের পরমানু বিপর্যয়- বাস্তব টা কি?


ফুকুশিমাঃ

রাজধানী টোকিও থেকে প্রায় দুশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে ফুকুশিমা দাইচি পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১১ মার্চ ২০১১, নয় রিখটার স্কেলের ভুমিকম্প এবং তার সাথে সাথে সুনামির জেরে জাপানের এই পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিষ্ফোরণ হয় এবং এর জেরে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় বিকিরন। সতর্কবার্তা জারি করা হয় সর্বত্র। এখনও ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রন করা যায়নি, চেষ্টা চালাচ্ছেন জাপান সরকার, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সারা পৃ্থিবীর পরমানু বিজ্ঞানীরা। ফুকুশিমার দুর্ঘটনা একই সঙ্গে অনেক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের- জাপানের পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির আপৎকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক ছিল না, নাকি পরমানু বিদ্যুৎ জিনিষটাই বিপর্যয় ডেকে আনে।

ফুকুশিমা পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১১ মার্চঃ

যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এত তোলপাড় তার নাম ফুকুশিমা-১। ফুকুশিমা-১ এর মোট ছ’টি ইউনিট। সুনামির দিন সকাল পর্যন্ত ১নং, ২নং, ৩নং ইউনিট চালু অবস্থায় ছিল। বাকি তিনটি ইউনিট মেরামতির কারনে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ ছিল। ১১ মার্চ দুপুরে সমস্ত উত্তর জাপানের সাথে সাথে আন্দোলিত হল ফুকুশিমা। যেহেতু ফুকুশিমা কেন্দ্রটি তৈরি হয়েছিল ষাটের দশকে তাই এর নকশা পুরোনো এবং সেই অনুযায়ী ২নং ইউনিটটি ভুকম্প ত্বরণ সহ্যক্ষমতা ছিল ৪.৩৮ মিটার প্রতি বর্গ সেকেন্ড, ৩নং ইউনিটের ৪.৪১ মিটার প্রতি বর্গ সেকেন্ড এবং ৫ নং ইউনিটের ৪.৫২ মিটার প্রতি বর্গ সেকেন্ড। অথচ সেদিন ২, ৩ ও ৫ নং ইউনিটে আছড়ে পড়েছিল যথাক্রমে ৫.৫, ৫.০৭, ৫.৪৮ ত্বরনের ভুকম্প। ১ নং, ৪ নং এবং ৬ নং ইউনিটে যে কম্পন এসে পৌঁছেছিল তা নকশা অনুযায়ী তাদের সহ্যসীমার মধ্যেই ছিল। সেদিন যেই না আন্দোলন শুরু হল, সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সতর্কীকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে চালু থাকা তিনটি ইউনিটে নিজে নিজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চুল্লিতে সর্বদা ধিকি ধিকি করে তাপ উৎপন্ন হতেই থাকে, তাছাড়া যে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ থাকে সেখান থেকেও কিছু পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হতে থাকে। তাই চুল্লি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও বাইরে থেকে ঠান্ডা জল পাম্প ও পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করে চুল্লি ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। একে বলে শীতলীকরণ ব্যবস্থা। ঠিকঠাক শীতলীকরণ হলে কয়েকদিনের মধ্যে চুল্লি এক্কেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। চুল্লিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ এনে শীতলীকরনের পাম্পগুলি চালু রাখার কথা। কিন্তু প্রায় একই সময় ভয়ানক সুনামির ধাক্কায় স্থানীয় পাওয়ার গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেও ছিল আপৎকালীন ডিজেল জেনারেটরের ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে শীতলীকরনের পাম্প চালু করা যাবে। কিন্তু ততক্ষনে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে থাকা ১৯ ফুট পাঁচিল টপকে ৪০-৫০ ফুটের বিশালকায় ঢেউ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যেকার সমস্ত কিছু লন্ডভণ্ড করতে শুরু করেছে যার ফলে ডিজেল জেনারেটরটাই চালু করা যায়নি। ডিজেল জেনারেটরের ব্যর্থতার পর শীতলীকরণ পাম্প চালু করতে ব্যাটারির ব্যবস্থা করা হয়। ব্যাটারির বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা আট ঘন্টা। ঠিক হয়, অন্যান্য কেন্দ্রগুলি থেকে আরও ব্যাটারি এনে অবস্থার সামাল দেওয়া হবে। সেটাও সম্ভব হয়নি কারণ সুনামির জলের তোড়ে তখন পাম্পের সাথে ব্যাটারির কানেকশন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ফলতঃ চুল্লির উত্তাপ বেড়ে গিয়ে চুল্লির ভেতরে শীতলীকরনের উদ্দেশ্যে জমে থাকা জল আবদ্ধ অবস্থায় প্রচন্ড বাস্পচাপ সৃষ্টি করে। এদিকে চুল্লিতে ইউরেনিয়াম থাকে যে ফাঁপা খোলকের মধ্যে সেই জারকোনিয়াম দণ্ডের জারকনিয়ামের সাথে জলীয় বাস্পের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস। মনে করা হচ্ছে এই হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রবল চাপেই ঘটে বিস্ফোরণ, যাতে চুল্লিগুলির একাংশ উড়ে যায়। এর পরের কাহিনী সবার জানা। জাপান সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার ভয়, তেজস্ক্রিয় বিকিরন ছড়াতে থাকা চুল্লিগুলিকে ঠান্ডা করে তাদের বিকিরণের পরিমান কমানো –সব নিয়ে উদ্বেগ কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। পরমানু বিদ্যুৎ বিরোধীরা স্বভাবতই তাদের গলার স্বর আরও একধাপ চড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন।

বাস্তব কি বলছে?

নিঃসন্দেহে পরমানু বিপর্যয় ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু শুধুমাত্র ভয় না পেয়ে আমাদের বাস্তবটকে ভালো করে বুঝতে হবে। নজর রাখতে হবে পরিসংখ্যানেও। আমাদের বুঝতে হবে শেষ হয়ে আসা কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃ্তিক গ্যাসের জ্বালানী দ্বারা আর বেশিদিন তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীতে যা কয়লা মজুত আছে তা দিয়ে চলবে বড়জোর দুশো বছর, খনিজ তেল চল্লিশ বছর এবং প্রাকৃ্তিক গ্যাস ষাট বছর। অথচ ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদাকে অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়া মানে সমস্ত কিছু থমকে যাওয়া। আর কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে আমরা প্রতি মুহুর্তে কত প্রাণের বলি দিচ্ছি সেটিও ভাবতে হবে। ২০০৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিবিসি নিউজ জানিয়েছে, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনির ধোঁয়া, যানবাহন ও কারখানার ধোঁয়ার প্রত্যক্ষ কারনে প্রতি বছর বিশ্বে মারা যান প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। এছাড়া কাঠের জ্বালানির ধোঁয়ার প্রত্যক্ষ কারণে গরিব দেশগুলিতে প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ’।এছাড়া পরোক্ষ ফলাফল তো আছেই। সেটি হল গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এই প্রবন্ধটি এলেবেলে কেউ লেখেননি। লিখেছিলেন বিবিসি নিউজের পরিবেশ বিষয়ক ইনচার্জ অ্যালেক্স কার্বি। তাছাড়া পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দূর্ঘটনার হার অন্যান্য বিদ্যুতের থেকে অনেক কম সেটিও প্রমানিত সত্য। ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পরমানু বিদ্যুতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৬৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলি নিয়ে একটি পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। সেখানে তারা কয়লা, প্রাকৃ্তিক গ্যাস, জলবিদ্যুতের পাশাপাশি পরমানুকেও রেখেছেন। তারা দেখেছেন প্রতি দশ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যেখানে কয়লার তাপবিদ্যুতে বার্ষিক মৃত্যুর পরিমান ৩৪২ জনের, প্রাকৃ্তিক গ্যাসে ৮৫ জনের, জলবিদ্যুতে ৮৮৩৩ জনের সেখানে পরমানুতে মাত্র ৮ জনের। নিউক্লিয়ার এনার্জি এজেন্সির ঘোষনা অনুযায়ী আধুনিককালের পরমানু চুল্লিগুলি এতটাই উন্নতি করেছে যে তার জন্মলগ্নের চুল্লির তুলনায় দূর্ঘটনাকালে তেজস্রিয় বিকিরণের সম্ভাবনা ১৬০০ ভাগ কমে গেছে।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও প্রাকৃ্তিক বিপর্যয়ে নিরাপদ নাকি? আমেরিকার বাফাল ক্রীক জলাধার, ক্যানিওন জলাধার, লনলেক জলাধার, টেটোণ জলাধার, ইতালির ভাল দি সাভা, ক্রোয়েশিয়ার পেরুকা, নিউজিল্যান্ডের অপুহা, নাইজেরিয়ার গুসাউ, কাজাকাস্থানের কিজিল আগাশ- গত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে ছোট বড়ো মিলে কয়েক শো জলাধারে দূর্ঘটনা ঘটেছে যেখানে প্রাণ গেছে বহু লক্ষ লোকের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপূরনীয়। বেশিদূর যেতে হবে না, মাত্র তিন বছর আগে কোশী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে নেপাল এবং বিহারে কি পরিনাম হয়েছিল?
মাত্র একদিনের মধ্যে উত্তর বিহারের আরারিয়া, সুপুল, সহর্ষ, মাধেপুরা, পূর্নিয়া, কাটিহার, খাগারিয়া, ভাগলপুর ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। নদীবাঁধের পাশে থাকা ২৭ লক্ষ লোকই যে শুধুমাত্র আক্রান্ত হয়ে ছিল তা নয়, বাঁধ ভাঙ্গা বন্যায় এসব অঞ্চলের প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হন। এত দ্রুত এত মানুষের মৃত্যু হয় যে তার সঠিক হিসেব রাখা সম্ভব হয়নি। এও তো প্রাকৃ্তিক বিপর্যয়। এখানেও আছে মৃত্যু, এখানেও আছে প্রভূত সম্পদের ক্ষতি, পূনর্বাসন-উদ্বাস্তু সমস্যা, বিপর্যয়ের রেশ না কাটাতে পারা মানুষদের মানসিক ভারসাম্যহীনতা।
বিপর্যয় সর্বদা ভয়ঙ্কর, সে যেখানেই হোক না কেন। মৃত্যু সর্বদা কষ্টের সে যারই হোক না কেন। সারা বিশ্বে প্রতি বছর কত লোক পথ দূর্ঘটনায় মারা যায় জানেন? ২০০৪ সালের রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় বারো লক্ষ। আর আহত হন প্রায় পাঁচ কোটি। তবে কি আমরা গাড়ি চড়া ছেড়ে গোরুর গাড়ির জমানায় ফিরে যাবো? ভারতের মত গরিব দেশ যেখানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ না চড়তে পান গাড়িতে, না তারা পাকা রাস্তায় হাঁটতে পান, সেখানে ২০০৪ সালে এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানুষ পথ দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। আর জাপানের পরমানু বিপর্যয়ে এখনও অবধি মারা গেছেন ক’জন? মাত্র ২ জন। বিকিরণে নয়, এরা মারা গেছেন আঘাতে এবং রক্তক্ষরনে। তাই যখন জ্বালানি সমস্যায় আমরা জেরবার, জীবাশ্ম জ্বালানীর ধোঁয়ায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংএর পৃ্থিবী ধ্বংসের হুমকি, এদিকে সৌর-বায়ু বিদ্যুতের মত পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎক্ষেত্র গুলি থেকে সুলভে পর্যাপ্ত পরিমান বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা পাওয়া যাচ্ছে না সে সময় স্রেফ হিরোশিমা-নাগাসাকি পরমানু বোমা বিস্ফোরনের ভয় নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হলে চলবে না। যে জাপানের হিরোশিমা দেখে পৃথিবী কাঁদে, সেই জাপান কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে পরমানু বিদ্যুৎকে নিজের দেশের অন্যতম শক্তিভান্ডারে পরিনত করেছে। উন্নত দেশগুলির উন্নত রাস্তা, উন্নত যানবাহন, উন্নত ট্রাফিক পরিচালন ব্যবস্থা যেমন দূর্ঘটনার হার কমিয়েছে তেমনই পরমানু চুল্লির উন্নতিও পারমানবিক বিপর্যয়ের হার কমাবে।

2 comments:

Jayabrata said...

Thank you Biplab da for such a great artical with full of informaton. It was necessary in the current scenario.

Jayabrata Panda.

Sayantan chaklader said...

osonkho dhonyobad apner ei chestar jonno. Jonosadharon ke sothik bhabe bojhale bhul dharona gulo bhenge jabe. Ajker dine amader ei chestai chaliye jaoa uchit.