Monday, October 14, 2019

কেঞ্জাকুড়ার মুড়িমেলা



একটি নদীর বুক ধু ধু করছে বালি বালির রং ঠিক সাদা নয় কাঁকুরে লালচে বালির মাঝে মাঝে ইতিউতি উঁকি মারছে পাথরের স্তূপ এবং মলিন ঘাস নদীতে জল আছে . . .
. . .এখানেই গত একশো বছরের ওপর ধরে হয়ে আসছে মুড়ি মেলা
প্রতি বছর মাঘ মাসের (এবছর ১৮ জানুয়ারি) তারিখ বাঁকুড়া জেলার কেঞ্জাকুড়ায় দ্বারকেশ্বর নদীর চরে এই অভিনব মেলাটি বসে। ভেলাইডিহা, লক্ষীশোল . . .
. . . দর্শনার্থীরা মেলায় কিছু কেনেন না। মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজ, লঙ্কা, বেগুনি, এমনকি শালপাতার থালা- সব বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। মুড়ি মাখতে প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করেন নদীতে চুয়া কেটে।. . .এই লোকায়ত প্রথাটি কালক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে এখন মুড়ি খাওয়াটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। কীর্তন হয়, তবে তা আশ্রমের এক কোনায়। . . .
কেঞ্জাকুড়ার নব্ব বছরের বাসিন্দা গোবর্ধন চন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক। তিনি জানালেন, মানভুমের অন্যতম পরবএখ্যানএর সূত্র ধরে. . .
. . . মাঠে খিচুড়ি রান্না করে বড় বড় কংক্রিটের চৌবাচ্চায় ভর্তি করা হয়। সারা দুপুর ধরে হাজার হাজার মানুষ মাঠে পাত পেড়ে বসে খিচুড়ি খান।. . .

. . . কিন্তু মুড়ির মতো একটি দৈনন্দিন খাবারকে নিয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এত লোকের সমাগম? তা কেবল রাঢ়বঙ্গেই সম্ভব


বিপ্লব দাস
১৭/০১/২০১৮

সৈন্যদল


ধরা গেলএকটি রাজনৈতিক দলের নাম এরকম করে বি, সি, ডি, নামেরও বিভিন্ন দল আছে পুরুলিয়ার একটি গ্রামের নাম ধরে নিলাম চাকভাঙ্গা জানি এই নামের কোনো গ্রাম নেই, হবেও না, তবে ধরে নিতে আপত্তি কী আছে এরকম ভাবেই ধরে নিলাম গ্রামেরই মাঝ চল্লিশের প্রৌঢ় দিনু বাগদি 
দিনু চারমাস জমিতে কাজ পায়। বছরে বেশ কিছুদিন ব্লক থেকে একশো দি্নের কাজে যোগ দেয়, পুকুর কাটা, রাস্তায় মাটি- এসবই। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ভাবে, সারাদিনে করলাম টা কী। সেই তো এক জায়গার মাটি অন্য জায়গায় ফেলছি। মাটি তো মাটিই রয়ে গেল। কাজটা কী আর হল। সপ্তাহে একদিন যায় নবীন মাহাতোর গোয়াল আর গুদাম পরিস্কার করতে। দিনুর দুই ছেলে, ছোটোটা নবীনের গরু চরায়। দিনুর বউকে ঠোঙ্গা, বড়ি এসব করতে হয়। সংসার চলে যায়, উপোষ থাকেনি কখনও
চাকভাঙ্গা হাইস্কুল মাঠে পর পর দুদিন দুটি রাজনৈতিক দল সভা করার কথা। দিল্লির গদিতে বসে থাকাদলের কয়লামন্ত্রীর সভা প্রথম দিন। সভা শেষে গ্রাম সফরে বেরিয়ে হঠাৎ কী হল, মন্ত্রী মশাই ঢুকে পড়লেন তার ঘরে। খাওয়া দাওয়া শেষে তখন উঠোনে বড়ি দেওয়ার পাঠ চলছে। ঘরে আয়োজন বলতে কিছুই নেই, হারুর মা মাদুর পেতে দিতে একচিলতে মাদুরে এতবড় একটা শরীর। ছোটোটা নবীন মাহাতোর বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে কাঁদোকাঁদো। কে যেন বলে দিয়েছে, তোর বাবা কে ধরতে এসেছে। মন্ত্রীজির চারহাতি গোঁফের তলা থেকে বাজখাই গলা, ‘মাইজি, খানা কুছ হ্যায় ঘরমে’? 
হারুর মা কি বলবে ভেবে না পেয়ে দিনুর দিকে তাকালে দিনু বলে ওঠে, ‘আগে জানলে বাপি ময়রার দকান থ্যেকে...’
নেহি নেহি, ইতনা ঘাবড়ানেকা কুছ নেহি, হাম সির্ফ দেখনে আয়ে ইস রাজ্য মে কিষানোকা কেয়া হাল হ্যায় 
ছোটোটা অত শত বোঝেনা। বলে দিল, ‘মা ভাত আছে না?’
মন্ত্রীমশাই হারুর মায়ের দিকে তাকায়, উত্তরের অপেক্ষায়। ঘোমটার আড়াল থেকে উত্তর আসে, ‘কালের, আমানি
চলেগা, চলেগা। জব ছোটা থা, রোজ ইয়ে খা কর হি স্কুল জানা পড়তা থা। মা জি কৃপা কিজিয়ে
হতবম্ব হারুর মা চলে গেল ভেতরে। মন্ত্রীজির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো কালো কালো, সবই কালো পোষাক পরা এক মহিলা চলল পিছু পিছু। খানিক বাদে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল স্টিলের তপতপে থালায় নিটোল হাতে গোছ করা দুমুঠো ভাত, এক টুকরো পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, নুন। 
থালা দেখে মন্ত্রী মশায়ের তৃপ্ত মুখে তখন হাজার ফ্ল্যাশের ঝলকানি, হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে দলীয় কর্মীদের মধ্যে, নতুনগাঁয়ের মানিক মণ্ডল, এই সবে কিছুদিন বক্তৃতা দিচ্ছে, এসে জড়িয়ে ধরল দিনু কে। 
হয়তো এই রোদগরমে ঘেমে নেয়ে এসেছে লোকটা, দু গ্রাস মুখে তোলার পরেই জল তেষ্টা পেল। যেই না জল পেটে পড়ল, খিদে গেল মরে। সেই কালো মেয়েটা থালা নামিয়ে রাখল উঠোনে
* ***
সন্ধেয় বাড়িতে এল একদল লোক। সবাই মুখচেনা, পাড়ার বিপদে আপদে থাকে। আগেসিদল করত, ইদানিংবিতে। বলল, ‘কাকা, কাল ঘরে থাকবে 
না, ওরা দিনুকে অবাক হবারও সুযোগ দেয়নি, ‘হ্যাঁ - নাবলারও। আর সেদিন শেষ রাতে দিনু ছোটোছেলের মুখে শুনল, ‘বাবা দেইখলম, বদরুদা আমাদের উঠানে খাটিয়ায় শুয়ে আছে
* ***
লোকে লোকারণ্য চাকভাঙ্গার মাঠ। দুকুল ছাপানো কংসাবতীর মতই। জৌলুস গতকালের চেয়ে অনেক বেশি। মাইকে ভেসে আসছে 'আকাশ ভরা... হ্যালো হ্যালো হ্যালো টেস্টিং... বিশ্ব ভরা প্রাণ...' ঘরে সবে ভাত খেতে বসেছে, হরি দৌড়ে এল, ‘বাবা কাগজে তুমার ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দিনু দেখল, হ্যাঁ সত্যিই তো, তারই উঠোন, এমনকি রোদে শুকোতে দেওয়া বড়িগুলিও। গতকালের পায়ের চাপে যেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। 
শেষ দুপুরে বদরু এল, পিছনে জনা তিনেক, ‘কাকা... কাকা
* ***
পর দিন বদরুই নিয়ে এল খবরের কাগজ। ভেতরের একটা রঙ্গীন পাতায় মঞ্চে সারি সারি লোকেরদের সাথে দিনু, হাতে পতাকা। নিচে বড় বড় করে কী সব যেন লেখা। হরি পড়তে শুরু করল, “বাঁকুড়ার পর এবার পুরুলিয়াতেও। গতকাল পুরুলিয়া শহর থেকে অনতিদূরে চাকভাঙ্গা হাইস্কুলের মাঠে প্রায় তিরিশজনদলের নেতাকর্মী যোগদান করলবি’. . . . .” খবরটার গুরুত্ব কতটা তা না বুঝেই কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে হারুর মা গেল জায়ের বাড়ি। 
ছোটোটা ঠিক তখনই এল কাঁদতে কাঁদতে। নবীন মাহাত বলেছে, ‘তর বাপের ছবি বেরিছে রে কাগজে। তকে দিয়ে কি বাগালি করাতে পারি? শনিবারে আয়, পাওনা টা লিয়ে যাস
এক মাথা রোদ নিয়ে দিনু দুপুরে বেরোল। কুড়িটা গরুর বাগালি, চলে গেলে অনেক লোকসান। নবীনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। আটচালার কাছে আসতেই বাদল মুদি দোকান থেকে হাঁক পাড়ল, ‘কাকা ভালই বাগালে। শুন। আমার কাছে হিসাব একশ সাঁইতিরিশ, কবে দিবে? আর কী, দুহাতে কামাবে ইবার 
নবীন কলেই ছিল। বলল, ‘আমাদের ঘরদিকে একবার যাও দাদা। গাছের কটা আম পাড়া আছে, ভাইপোদের জন্যে আটাকলের মেশিনের আওয়াজে নবীনের গলা তখন উদারা সপ্তক।
ঠায় দু ঘণ্টা দাঁড়াতেও নবীন কোনো কথা পাড়ছেনা দেখে দিনু সিঁড়িতে নামল। পিছন থেকে নবীনের গলাহারুকে বলে দিয়েছি সব। ইসব ধুয়া মুছার নংরা কাজ তুমাকে দিয়ে করাব? আমার ঘাড়ে একটাই মাথা নাকি? কাজরীর ব্যাটাটা আছে তো, উই করুক ক্যানে
নবীনের কল থেকে বাড়ির মধ্যে অন্তত জনা দশেক জিজ্ঞেস করল, ঘরে নতুন টিন কবে লাগানো হচ্ছে বা এবারে স্কুলের বাইরে পাকা রাস্তা হবে কিনা। ঘরের মুখে হারুর সাথে দাঁড়িয়ে উত্তম কম্পাউণ্ডার। কম্পাউণ্ডার খুবই উত্তেজিতকি কাকা? ইব্যারে তবে দাঁড়ায়ে যাও, আর ক্যানে
পঞ্চায়েত অফিস থেকে হারুকে বলে পাঠিয়েছে, ‘তোর বাবাকে এখন আর লেংটি পরে কোদাল হাতে রাস্তার কাজে যাবার দরকার নেই। কদিন অপেক্ষা করতে বল

দিনুর মাথা আর কাজ করছে না। কানে ভোঁ ভোঁ করছে একটাই শব্দ, কাকা। চালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে তার স্থির দেহটি। লুঙ্গির খুঁট থেকে টাকা কটা বের করতে করতে দেখে হারুর মা উঠোনে উবু হয়ে বসে পরশুর চ্যাপ্টা বড়িগুলোকে আবার পাহাড়ের আকার দিতে শুরু করেছে। উঠোন ভর্তি সার সার পাহাড়। সৈন্যের মিছিলের মত। একলাফে ডিঙ্গিয়ে পেরোনোও মুশকিল

বিপ্লব দাস
০২/০৭/২০১৮