Monday, October 14, 2019

হাতি


হাতিরা আমাদের ছোটোবেলার বাড়ির সামনে দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে কোথায় যেত জানি না আমার দাদুকে দেখে আমরা ততদিনে পূব পচিম মুখস্থ করে ফেলেছি মনে পড়ছে, শীতকালে যখন শহরে কাঁচা সবজির ঢালাও বাজার, তখনই বোধহয় হাতিরা পাড়া দিয়ে যেত 
হাতিগুলি আমাদের জন্য নিয়ে আসত তীব্র কোলাহল। গলার ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বণিতে আমাদের রাস্তা তখন মন্দির চত্বর। তাদের শান্ত চোখ, মায়াবী ঘাড় হেলানোয় আমরা মগ্ন হয়ে থাকতাম। হাতির চাহনি শীতের সকালের মতই প্রলম্বিত, চলে যাবার পরেও দীর্ঘকাল তা আমাদের মনের স্মৃতিপটে আঁকা থাকত 
তারা দলে তিন বা চারটি, কিন্তু এতেই পুরো রাস্তা একটি পল্টনের রূপ পেত। আমাদের রাস্তার ধারের দেয়ালগুলির দিকে ওরা তাকিয়ে থাকত নীরবে। দক্ষিণের জঙ্গলের সবুজ পর্দা দেখতে অভ্যস্ত চোখগুলি যেন খুঁজত কোনো বিশেষ রঙ, সাদা কালোর বেমানান শহরে। উঁচু পিঠে বসানো থাকত বাহারে গদি, গদির ওপরে রংবেরঙের রেশমি কাপড়, চকচকে ঝালর। জন্তুটির ছন্দময় চলনের সঙ্গে সঙ্গে সেসব দোলে। দুলতে দুলতে তারা দেখতে থাকে আমাদের পাড়ার জানালাগুলি, ছাদগুলি, স্ত্রীলোকেদের এবং পুরুষদের। 
এরকমই কোনো এক পল্টনের শেষ হাতিটি একবার আমাদের মাঠে বসে পড়ে, এগোতে চায় না। মাহুতেরা এমনিতে ওখানেই তাঁবু গাড়ত বরাবর। সেবারের দল অন্য ছিল, নাকি তাড়া ছিল জানিনা, মাঠে বিশ্রাম ছাড়াই পাড়ি দিতে উদ্যত ছিল। তো, সেই হাতিটি, বয়সে ছোট বলেই বোধ হয় মাঠের বিশ্রামের ডাক ঠেলতে পারছিল না। বাকিরা তাড়া থাকায় চলে যায় ওকে ছেড়ে। ওর সাথে রয়ে যায় কিশোর মাহুত
দু দিন কেটে যাওয়ার পরেও হাতি তার জান্তব জেদ ধরে থাকে। তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে রক্ষক হয়রান। হাতির মন তখন শহরের কংক্রিটের মতই, ভীষন শক্ত। শীতের হিমেল হাওয়ায় রাত যখন প্রগাঢ়, তখনও হাতির মন গলেনা, এমনকি কুঁচকে যাওয়া কিশোরকে দেখেও।
আমরা নাওয়া-খাওয়া-ইসকুল-খেলা ছেড়ে সর্বদা শোওয়া হাতির পাশে লিলিপুটর মত সেঁটে। বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আলু, কপি- সব নৈবদ্যের মত সাজিয়ে দিতাম। গোটা কুমড়ো, শশা কিছুই বাকি থাকত না। তার মাঝ থেকেই কিশোর গাছের শেকড়ে উনুন সাজিয়ে নিজেরটুকু বানিয়ে ফেলত।
রাত হলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত অদ্ভুত কোনো কারণে। কেন যে বইতে পড়েছিলাম হাতি তরঙ্গপ্রেরণে সক্ষম। জানালায় মুখ লাগিয়ে কুয়াশার পর্দায় দৃষ্টি ঠেলে ঠেলে খুঁজে বেড়াতাম হলুদ মাঠে কালো প্রস্তরখণ্ডের মত জীবটিকে
এক সকালে কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালায় তাকিয়ে দেখি মাঠে ভয়ানক শোরগোল। ক্ষুদেটি উঠে দাঁড়িয়েছে, যাওয়ার জন্য তৈরি। শীত ভোরেই কিশোর মাহুত পাশের ডোবা থেকে দু ডুব লাগিয়ে মাথায় তিলক কেটে পিঠে চেপে বসেছে। পাড়ার যুবক, প্রৌঢ়, বৃ্দ্ধ-বৃ্দ্ধারা ওদের যাবার পথ করে দিতে উদগ্রীব। আমরা জন বালক ধীর পায়ে নিমগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কিশোর মাহুত তার জন্য বড়দের পক্ষ থেকে নিয়ে আসা সব উপহার, খাদ্যসামগ্রী থলে ভরে নিল। অভিবাদন জানালো সবাইকে, লুফে নিল ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা, গদি থেকে ঝুলতে থাকা থলি ভর্তি হয়ে গেল চাল, আলু, কলাতে। এরপর ওরা মাঠ ছেড়ে চলে যায় সূর্যের দিকে। 
পেছনে ফেলে যায় শহরটা, যেখানে শীত তখন জাঁকিয়ে পড়েছে। শুধু আমরা কজন গাছের তলায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। স্কুলের ব্যাগে লুকোনো চালের দানা এখনও কটা রয়ে গেছে

 BIPLAB DAS 11/08/2018

No comments: