Monday, October 14, 2019


কচি সেগুনপাতা ঘষলে রক্তের মতো লাল রস বের হয়
এরকম এক লোককথার সাথে শবরদের অরণ্যে বাস করার কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে
শবর এবং অসুরদের স্বর্ণযুগ সমসাময়িক। বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থঐতেরেয় ব্রাম্ভণেশবরদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে শবরকে ঋষি বিশ্বামিত্রের অভিশপ্ত পুত্রের বংশধর বলা হয়েছে। রামায়নেও বাল্মিকী আমাদের শবরীর প্রতীক্ষার গল্প শুনিয়েছেন। প্রথম শতাব্দীতে প্লিনি রচনায় এবং গ্রিক পণ্ডিত টলেমির ভাষ্যে 'শবর' উল্লেখ পাওয়া যায়। চর্যাপদের শবরপাদ দেবী পর্ণশবরীর উল্লেখ পাই। বাণভট্ট লিখেছেন, হর্ষবর্ধন তার হারিয়ে যাওয়া বোন রাজ্যশ্রীর অনুসন্ধানে অরন্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক শবর যুবকের সন্ধান পাননির্ঘাত নির্ঘাত ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের শবর সেনাপতির ভাগ্নে। বাণভট্টের কথায়, নির্ঘাত যেন পাহাড়ের চলমান তমাল বৃক্ষ কিম্বা বিন্ধ্যপর্বতের গলন্ত লৌহসার। ডালটন সাহেব বিহারের সাহাবাদ জেলার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে বলছেন, ভোজপুরে ভোজরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শবররাজ ফুদিচন্দ্রকে পরাজিত করে
মধ্যভারতের সমৃদ্ধ শবরেরা বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে ধীরে ধীরে পূর্বভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। শবর, শভর, শর্শাপরা, শুইরি, শায়ার, শভরালু, শোরি, শওন- বিভিন্ন অঞ্চলে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, কয়েক শতক আগেও এরা এক মায়ের ভাই ছিলেন। ছিলেন সমৃদ্ধ অনার্য জাতির প্রতিনিধি। আর্যিকরণের প্রয়োগ কৃ্ষি জমি থেকে যতই অরণ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে, শবরেরাও ততই গহীন অরণ্যের তালাশ করেছে। ইংরেজরা আসার আগে ভারত বলে কিছুই ছিল না। কয়েকশো স্বাধীন রাজা, কয়েক হাজার জমিদার- এই বিন্যাস সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পরিপন্থী। কখনই সর্বত্র এক শাসন এক আইন আনার প্রচেষ্টা হয়নি। ফলত আর্যিকরণ বা মোগল ইজারাদারি শবরদের ঘরছাড়া করলেও তারা ক্রমশ পিছু হটে চলায় তাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল
মুশকিল হল ইংরেজরা এসে। ইংরেজ শাসনের অন্যতম দিক ছিল জঙ্গল কেটে করযুক্ত কৃষিজমি বানানো, অরণ্য সম্পদ দিয়ে নগর এবং নাগরিক পরিকাঠামো বানানো। অনেক জাতি উপজাতির মত শবরদের অর্থনীতি এবং সামাজিক বিন্যাসেও হাত পড়ল এবং ব্যাপক হারে অরণ্য ধ্বংসের কারনে শবরেরা ক্রমাগত কোনঠাসা হল। সেই প্রক্রিয়া একুশ শতকে প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে। শবরেরা তাদের নিজেদের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন ভাঙ্গা বাংলা, ভাঙ্গা হিন্দি কিবা সাদরিতে তারা কথা বলেন। এখন শবরেরা কালি মনসা শীতলার পুজো করেন। কোথায় সেই অরণ্যদেবীরা? তারা খাদ্যাভাবে মারা যান, আসলে তারা কেউ শবর নন। তাদের শবরত্ব ঘুচে গেছে অনেকদিন আগেই। কেড়ে নেওয়া হয়েছে জঙ্গলের ওপর তাদের পরম্পরার অধিকার। আমরা, যারা আইন বানাই, আমরা যারা নগর-শহর-মফস্বলে থাকি, জঙ্গলের পাতা-ফল-ফুল-কাঠ-মধু-ঔষধি আর আমাদের অক্সিজেনের সরবরাহের নিশ্চয়তা বজায় রাখতে পরিবেশপ্রেমী হয়ে উঠে হঠাৎ একদিন ঠিক করে ফেললাম জঙ্গলে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু যারা অরণ্যবাসী? যারা চাষাবাদে অভ্যস্ত নয়? যারা সঞ্চয় শেখেনি? তাদের কথা কখনও বিবেচনায় আনা হয়নি। তারা ক্রমশ ইনসাইডার থেকে আউটসাইডার হয়ে গেছে। সাঁওতাল চাষীটিও শবরকে হীন চোখে দেখে
ভারতকে প্রগতিশীল জাহির করতে নেহেরুর বানিয়েছিলেন আদিবাসী পঞ্চশীল। যা শেষ পর্যন্ত একটি সরকারি নথি। বাস্তব প্রয়োগ কখনই হয়নি
অদ্ভূত তথ্য এই যে, মোগল শাসনের শেষ দিকে হওয়া বেশ কয়েকটি খরা এবং মন্বন্তরে বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুরের বিভিন্ন কৃ্ষিজ গ্রামে প্রভাব পড়লেও অরণ্যবাসী শবর, বীরহোড়, খেড়িয়া, হো, কোড়া এবং প্রায় বেশিরভাগ সাঁওতাল গ্রামে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কারন সেসময় অবধি তাদের জীবনযাপনের বেশিরভাগই গাছ-পাতা-পাথর নির্ভর। হ্যাঁ, এটা বাস্তব যে, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমরা অনেক উন্নতি করে ফেলেছি কিন্তু সমাজ কাঠামো এবং বেঁচে থাকার পদ্ধতিগত দিক দিয়ে আমরা কোথাও যেন দিশেহারা। এগিয়ে ছিল শবরেরা।
বিনে পয়সায় চাল-ডাল-পোষাক-ওষুধ দিয়ে একটি মানুষকে কয়েক দিন বা কয়েক বছর বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু তার বেঁচে থাকার আধারটিকে এভাবে টিকিয়ে রাখা যায় না। আমরা বুঝিনি। সত্যি বলতে কী, আর বোঝার সময়ও নেই
দে আর জাস্ট ডিনাইং টু সারভাইভ
পৌষ মাসে আর গাইবার কেউ থাকবেনা-

আকাল বছর আল্য বাতাস
উড়াই দিল্য চালের পুয়াড়
খুদ-কুঁড়া ফুঁকে গেল্য ভঁড়রে
তাও পিঠ্যা হবেক মকরে

BIPLAB DAS
01/12/2018

No comments: