তখন সিঁড়িতে নামতে বাধ্য হতে হয়।
সান্থালি ভাষার প্রথম বই হল সংগীতের। আমেরিকা ব্যাপটিস্ট মিশনের রেভারেণ্ড ফিলিপ জলেশ্বর অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচলিত লাগড়ে গান, পাতা গান, উপকথা সংগ্রহ করেন এবং সেগুলি একস্থানে জড়ো করে এই বইটি বের হয়। সম্ভবত এটি বাংলা লিপিতে বের হয়েছিল। ঘটনাটি ১৮৪৫ এর, এবং সত্যি বলতে কী, এর আগে তাদের জীবনে প্রথাগত লেখা-পড়ার ব্যাপারটি না থাকায় এবং সম্পূর্ণ অন্য এক ডাইমেনশনে তাদের জীবন চলতে থাকায় সুপ্রাচীন গল্প কবিতা, গান, বিনতী কোনোটাই অক্ষরমালায় গেঁথে রাখার প্রয়োজন হয়নি। হতও না। তারা ভাবত না সবেরই কোথাও না কোথাও একটা শেষ থাকে, কিছু কিছু জিনিস ক্ষয়ে যায়।
শেষের প্রথম পর্ব।
খিষ্ট্রধর্ম প্রচারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে হোক বা করুণা পরবশ হয়ে হোক, মোট কথা মিশনারিরা সেই গান-কবিতাকে সংরক্ষণ করার কথা ভেবে বসে এবং রোমান হরফে সান্থালি ভাষাকে ছাপযোগ্য করে তোলে। ১৮৬৩ তে ডাঃ লেপসাস সেটিকে আরেকটু সংশোধন করলে দুমকার বেনাগাড়িয়া থেকে পর পর সান্থালি বই-পত্রিকা ছাপা হতে থাকল। ততদিনে মিশনারি আবহাওয়াতে থেকে বিরাম হাঁসদা্, ডোডেম হাঁসদা, খুদিয়া মারাণ্ডি, বাবুরাম বেঞ্জামিন সরেন সহ অনেকে উঠে এসেছেন। পাল্লা দিয়ে সাহেবরাও ইংরেজিতে পর পর সান্থালি সংস্কৃতি বিষয়ক বই লিখে যাচ্ছেন। আদিবাসী চিন্তায়-চেতনায় অজান্তেই ঢুকে পড়ছে যীশুর রক্ত।
শেষের দ্বিতীয় পর্ব।
বিশ শতকের শুরুর দিক। ছোটোনাগপুর মালভুমির সর্বত্র রেল এবং সড়কপথ চালু হতেই অরণ্যচারীরা শিক্ষিত মূলধারার সান্নিধ্যে এল। অপর্যাপ্ত মিশনারি স্কুল এবং শিক্ষা-চাহিদা অবধারিত ভাবে তাদের ঠেলে দিল কাছাকাছির বাংলা, হিন্দি কিম্বা ওড়িয়া মাধ্যমে। শিশুর অ-আ-ক-খ, চেনা, জানা, কোনোটাই মাতৃভাষায় রইল না। সেসময় যারা নিরক্ষর ছিলেন তারা বরং নিখাদ ছিলেন।
কেউ কেউ কিছু বুঝতে পারেন।
সংকট বুঝেছিলেন শিলদার সাধু রামচাঁদ মুর্মু এবং ময়ুরভঞ্জের রঘুনাথ মুর্মু। তাঁরা সান্থালি শোনিতে তৈরি করেন ‘মজ দাদের আঁক’ এবং ‘অলচিকি’- এই লিপি দুটি। এর মধ্যে অলচিকিই ধীরে ধীরে পরিচিতি পায়। কিন্তু স্বাধীন ভারতে দেখা যায়, তারা বাংলা, ওড়িয়া, দেবনাগরী, রোমান, অলচিকি - পাঁচরকম লিপির বোঝা বহন করছে। সভ্যতার গায়ে গায়ে থেকে যে লিপি সাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী, যে লিপি ভীষন পুরুষতান্ত্রিক, অহঙ্কারি, রাজনৈতিক, সুযোগসন্ধানী- সেই লিপিগুলির ভার বহন করা তাদের কাছে কত বড় বোঝা ছিল হয়তো কোনোদিন বুঝতেই পারবনা। নেহেরু জমানার দ্বিতীয় ধাপ থেকে সর্বত্র স্কুলশিক্ষা চালু হতে তাদেরকে আমাদের মতো করে নেওয়ার একটা ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেণ্ট চালু হল। বিক্রিয়ায় অনুঘটক আমাদের ভাষা আর লিপি।
কেউ কেউ প্রতিবাদী থাকেন।
তারা রঘুনাথ মুর্মুর তৈরি অলচিকিতে পঠনপাঠনের দাবি জোরালো করল। অন্যত্র না হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশেষে মেনে নেয় ১৯৭৯ তে। কিন্তু সরকারি স্বীকৃ্তি নয়, কোট আনকোট নীতিগত ভাবে। চাপে পড়ে। অলচিকিপন্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত হলনা। এদিকে যারা ইতিমধ্যেই বাংলা কিম্বা অন্য কোনো লিপিতে লেখাপড়া শিখে এসেছেন তারাও অলচিকিকে সমর্থন করতে গিয়ে বেঁকে বসলেন।
কেউ কেউ কিছুই পায়না।
কখনো কখনো একটি গোটা জাতিই কিছু পায়না। এরাও পায়নি। এত সমৃদ্ধ মৌখিক সাহিত্যভাণ্ডারকে নাড়াচাড়া করার কোনো লিপি পেলনা। লিপি না পাওয়াতে ভাষাগত ভারসাম্য এবং সংস্কৃতি নষ্ট হল। শেখার মাধ্যমটি অন্য হওয়াতে সংস্কৃতিতে দ্রুত অনুপ্রবেশ হচ্ছে। আমরা জেনে বা না জেনে হই হই করে ঢুকে যাচ্ছি সেখানে। ঈশ্বর সাকার হতে চাইছে। অলচিকি এসেছে বটে, লড়ায়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। অবহেলা নিত্যসঙ্গী। অধিকারের লড়াই আর কত দীর্ঘ হবে?
BIPLAB DAS
06/03/2019
06/03/2019
No comments:
Post a Comment