আন্তর্জাতিক নারী দিবস- একটু অন্যভাবে ভাবুন।
পাঁচ বাড়ি বাসন মাজে যে মহিলা ,
তাকে বলি এবার স্বাধীনতার
পঞ্চাশ বছর। জানো?
ব্যাজার রাগ রাগ মুখ করে মহিলা বলল,
তার এখনও দু বাড়ি কাজ বাকি।
(এই দিনগুলো/ ব্রত চক্রবর্তী )
দেখে ভালো লাগে কত কত গৃহবধু ছাপোষা জীবন ছেড়ে নতুন কিছু করার উদ্দ্যেশ্য আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পথে নামেন। হাজার সেমিনারের লাখো বক্তৃতায় প্রেক্ষাগৃহগুলি গমগম করে সেদিন। তাদের আবেগ, পরিশ্রম, সংগ্রামী মানসিকতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং সহানুভুতি থাকলেও নারী আন্দোলনের কিছু পুরো ব্যাপারটিই কিছু মৌলিক প্রশ্নের সামনে এসে যায়।
হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান যে ধর্মের দিকে তাকাই না কেন দেখতে পাবো সেখানে নারী রয়েছে দাসের ভুমিকায় আর পুরুষ প্রভুর। মনুর বিধান হিন্দুদের এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। সেখানে চোখ রেখে দেখুন, পাবেন-
“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা না স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যহর্তি ।।
(মনুর বিধান ৯/৩)
অর্থাৎ নারীকে পিতা রক্ষা করবে কুমারী কালে,স্বামী যৌবনকালে, বার্ধক্যে পুত্ররা, স্ত্রী মানুষ স্বাধীনতার যোগ্যই নয়। মনুসংহিতার ২/৬৭ তে আরও আছে যে,
বৈবাহিক বিধিঃ স্ত্রী নাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহাগ্নি পরিক্রিয়া ।।
কি বুঝলেন প্রিয় পাঠক পাঠিকারা ? আপনি হিন্দু হলে আপনাকে মানতেই হবে যে, বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন, পতিসেবা হল সারা জীবন গুরুগৃহ বাসের সমান, আর গৃহকর্মই হল হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা। যে সমস্ত মহিলারা একই সাথে ফেব্রুয়ারি মাসে শিবরাত্রি করেন আর মার্চে নারীদিবসে গলা ফাটান তাদের বলি শুনুন, মনু বলেছে ( ৫/১৫৪)- পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতই পূজা করবে।
হিন্দুধর্মের সর্বত্র পুরুষের লাম্পট্য, অত্যাচার, শাসন কে পদে পদে স্বীকার করা হয়েছে, বাহবা দেওয়া হয়েছে। তৈত্তীরিয় সংহিতায় (৬/৬/৮/৫) বলা হয়েছে- “ যজমান দীক্ষার দিনে গণিকা সাহচর্য বর্জন করবেন, তারপরদিন পরস্ত্রীর সাহচর্য এবং তৃ্তীয় দিন নিজ স্ত্রীর সাহচর্য বর্জন করবেন”। অর্থাৎ দীক্ষার দিনেও পরস্ত্রীর সাহচর্য করার অনুমতি আছে। দীক্ষার দিন ছাড়া অন্যান্য দিনে গণিকার কাছে যাওয়ার নিষেধ নেই। আসলে গণিকা বা পরস্ত্রীর সাথে বিছানায় ওঠাকে হিন্দু ধর্ম কোনো দিনই নিষেধ করেনি বরং বেশ তোল্লায় দিয়েছে। মনুসংহিতা এবং পুরাণ অনুযায়ী হিন্দু দেবতাদের জন্ম, তাদের নারীলোলুপতা, নারীসঙ্গের যে বর্ণনা পাই তা যে কোনো পর্ণোগ্রাফির গল্পকেও হার মানাবে। পৃথিবীর বড় বড় ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে ইসলাম এসেছে সবার পরে, অর্থাৎ সবচেয়ে আধুনিক। তবু দেখা যায় নারী দমনে তার কাছে অন্যান্য ধর্মমতগুলোও হার মেনে যায়। কোরাণে আছে (সুরা নিসা ২২৩), “স্ত্রী তোমাদের শস্য ক্ষেত্র তাই তোমাদের শস্য ক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পারো”। মুসলিম শরিয়া আইন তো ভয়ঙ্কর। একজন স্বামী তার একগুচ্ছ স্ত্রীদের ওপর যখন তখন যৌন অধিকার ফলাতে পারে- যা ধর্ষনেরই নামান্তর। স্বামীর অধিকার আছে কোনো কারন না দেখিয়ে শুধুমাত্র তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে যখন তখন স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেওয়ার। কেনিয়া, ঘানা, সোমালিয়া, মিশর, নাইজেরিয়া, সুদান সহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে খৎনা প্রথা। কি নির্মম। কি ভয়ঙ্কর। স-অব এসেছে ধর্মের হাত ধরে। খৎনার সময় বালিকার চিৎকার ঢেকে রাখতে আশেপাশের মহিলারা সুর করে গাইতে থাকে “আল্লা মহান, মহম্মদ তার নবী; আল্লা আমাদের সমস্ত পাপ থেকে দূরে রাখুক”। মুসলিম নীতিনির্দেশক গ্রন্থ হাদিশে রয়েছে “নারী শয়তানের রূপে আসে আর শয়তানের রূপে যায়”। অবশ্য নারীদের চুড়ান্ত ভাবে অপমান করতে হিন্দুরাও কম যায়না। মহাভারতের অনুশাসন (৩৮)পর্বে চোখ রাখলেই পাবেন, “ তুলা দন্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়োবানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও আগুন কে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান সমান হবে”। কোথাও কোথাও নারীদের জোঁকের সাথে তুলনা করা হয়েছে তো কোথাও লাঠ্যৌষধ দেওয়ার কথাও বলা আছে।
ভারত রাষ্ট্রের আস্তিনে ঢোকানো তুরুপের তাস বিবেকানন্দও যে নারী প্রগতির আন্দোলনে বাধা দিয়েছেন। তিনি বরাবর সতীদাহ প্রথার পক্ষে ছিলেন, বিধবাদের পূনরায় বিবাহ পছন্দ করতেন না, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। যদিও বিবেকানন্দের কর্মজীবনের অর্ধশতাব্দী আগেই রামমোহন সতীদাহ বন্ধে ব্রতী হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রোধের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। হ্যাঁ। এটাই সত্যি। বিবেকানন্দের নিজের লেখা বই, পত্রাবলী পড়লেই বেরিয়ে আসে সত্যি টা। আসলে তিনি পুরুষতান্রিক সমাজের আর পাঁচটা সমর্থকের মতই ছিলেন, যারা চায়- নারীরা শিক্ষায় দীক্ষায় পুরুষদের সমকক্ষ হতে সচেষ্ট না হয়ে, মানুষ না হয়ে, নারী হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করুক। নারীর শিক্ষা হবে একটি খন্ডিত মানুষে পরিণত হওয়ার শিক্ষা। যে শিক্ষা আবর্তিত হবে গৃহকর্ম, রন্ধন, সেলাই, সহ্যগুণ, লজ্জা, সেবা, আচার ইত্যাদি বিষয়ে উৎকর্ষতা লাভের মধ্য দিয়ে। হে হিন্দু ফেমিনিষ্টরা দ্বিচারিতায় ভুগবেননা, যেকোনো একদিকে যান।
তবে, শুধু কি নারীই শোষিত? নাকি নারীকে দমন করছে যে পুরুষ, সেও তার সমাজের কাঠামোর প্রেক্ষিতে একই ভাবে শোষিত হচ্ছে না? ক্ষমতা যার হাতে সেই শোষন করতে পারে। তাই আমরা দেখেছি যে কোনো নারীই যখন ক্ষমতার পিরামিডে ওপরের দিকে বসেছে তখন সেও একই ভাবে মেতেছে শোষণ খেলায়। ইন্দিরা গান্ধি থেকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, প্রিন্সিপ্যাল মিস পাকড়শী থেকে কমলার মা- তাকিয়ে দেখুন একবার। রাজনীতি,দুর্নীতি,সৌন্দর্য্য,যশ,অর্থ- ক্ষমতার উৎস অনেক কিছুই হতে পারে। স্বাধীনতা হরণ হচ্ছে মানুষের। যার অর্ধেক পুরুষ, অর্ধেক নারী। তাই আমাদের মত দেশে স্বাধীনতাহীনতার সমস্যাটি শুধু নারীর নয়, পুরুষেরও, যাদের সিংহভাগ কোনও না কোনও ভাবে স্থূল অর্থেই পরাধীন। যেসব লেখক, বুদ্ধিজীবি,ও সমাজ বিজ্ঞানীরা আজ নারী স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেছেন তারা জানেন নারী স্বাধীনতা নিয়ে কলম চালানো নিরাপদ, সাথে উপরি পাওনা প্রগতিশীলতার তকমা। কিন্তু দেশের মানুষের সার্বিক স্বাধীনতার প্রশ্নে সরব হলে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুললে ধনিক শ্রেণি, তাদের পাপোশ সরকার, পুলিশ-প্রশাসনের সক্রিয় বিরোধিতার সামনা সামনি পড়তে হবে, রাষ্ট্রের তল্পিবাহক প্রচারমাধ্যমগুলি ব্ল্যাক আউট করবে, এসব অবধারিত বলেই তারা দেশের মানুষের সার্বিক স্বাধীনতার প্রশ্নটি নিয়ে আশ্চর্য রকম নীরব থাকেন। তাদের প্রায় সবাই ঝালে ঝোলে অম্বলে থাকাটাই পছন্দ করেন। তারা নারী দমনের অন্যতম হাতিয়ার বলে ধর্ম কে আঘাত করতে চাননা। কারণ তারা বরাবরই রাষ্ট্র নামক সিস্টেমটির কাছে প্রগতিশীল থাকতে চান। আন্দোলনকারীরা ভাবতে বসেন না, এতদিন নারীদের দমিয়ে রাখার ফলে যেমন লিঙ্গের ভিত্তিতে সমাজের অর্ধেক মানুষ বিভক্ত বিভক্ত ছিলেন, পিছিয়ে ছিলেন চিন্তায়-চেতনায়। তেমনি নারীবাদী আন্দোলনের গতিমুখ অনেকাংশেই পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে পড়লে নারী-পুরুষের বিভেদটি রয়েই যাবে, যাতে লাভ হবে ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা শোষকদেরই।
নারী আন্দোলনে থাকব এবং মনে প্রানে হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রীষ্টান থাকব, শিবের মত বর পাওয়ার জন্য শিবরাত্রি পালন করব এও যেমন হয়না তেমনি নারী আন্দোলনকে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিতদের আন্দোলনের বাইরে গিয়ে ভাবাটাও মুর্খামির পর্যায়ে পড়ে। কেননা ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে যে বিভাজন চলে সেই বিভাজনেরই একটি অংশ হল লিঙ্গের ভিত্তিতে বিভাজন। মানুষ এভাবে যতই বিভাজিত হতে থাকবে ততই শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শোষিতদের ক্ষুব্ধতা, প্রতিরোধ, সংগ্রাম ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে হতে অণু পরমাণুতে পরিনত হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১)যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তিঃ প্রবীর ঘোষ
২)নারীঃ হুমায়ুন আজাদ
৩)আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা (পঞ্চম খন্ড)
৫) এই দিনগুলোঃ ব্রত চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment