Monday, September 16, 2019

‘ওয়ার্ল্ড কার ফ্রি ডে’( WORLD CAR FREE DAY )

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=2553689734651413&set=a.104403046246773&type=3&theater
‘ওয়ার্ল্ড কার ফ্রি ডে’( WORLD CAR FREE DAY ) আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, রবিবার।
বেশ কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকটি শহরে চলবেনা বাস, ট্যাক্সি, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরবাইক। বছর পঞ্চাশেক আগে খনিজ তেলের সঙ্কটের সময় কোথাও কোথাও এরকম দিন পালনের প্রতীকী প্রয়োজন পড়েছিল। সময় পাল্টেছে। এখন পরিবেশের কথা মাথায় রেখে দিনটি পালিত হয়। কলম্বিয়ার বোগোতার মত বেশ কিছু শহরে বছরে একবার মাত্র ‘কার ফ্রি ডে’ নয়, সপ্তাহে বা মাসে এক দিন করে গাড়ি চালানো হয়না। সবাই যায় হেঁটে বা সাইকেলে।
৩৬৫ দিনে ১ দিন দূষণ কমলে কী আর হবে?
মানছি আপনার কথা। এতে হয়ত ১ শতাংশও দূষণ কমবে না। কিন্তু মাত্র ৫ শতাংশ ডি এ বাড়লেও তো আনন্দের শেষ থাকেনা। তাই ২২ সেপ্টেম্বর ‘কার ফ্রি ডে’ পালন করি চলুন।
এটা একটু বেশিই আঁতলামি হয়ে যাচ্ছে না কি? গাড়ি থাকতে সাইকেল চড়ব, পায়ে হাঁটব?
রোজ সন্ধ্যেয় হুইস্কি ভদকা গিলেও তো পুরুলিয়াতে মহুয়া খেতে যাই। তাই ‘একটা কার ফ্রি ডে’।
আমি একা এটা করলে দূষণ বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কি?
না, হবে না। এই বিশাল পৃথিবীতে আমি-আপনি নগণ্য। আমাদের কেউ হিসেবের মধ্যে ধরেই না। তাই তো আমার-আপনার গ্ল্যামারও নগণ্য। আসুন একদিন গ্ল্যামার ছাড়ি, প্রয়োজন ছাড়ি। সবাইকে বুক বাজিয়ে শেয়ার করে জানিয়ে দিন ‘কার ফ্রি ডে’।
যে কাজগুলো গাড়ির জন্য করলাম না। সেগুলো তো পরের দিন করতে হবে। কাজটির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ধোঁয়া সেইই তো বেরোলো। লাভ কিছু হল কি?
কখনও হিসেব কষে দেখেছি, সারাদিনে আমরা অ-কাজে কতটা ধোঁয়া বের করি? কিছু অকাজের ধোঁয়া তো বেরোলো না। তাই তো হ্যাপি ‘কার ফ্রি ডে’।
‘কার ফ্রি ডে’ পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্রাইসিস থেকে উঠে আসা একটি আইডিয়া। ক্রাইসিস মোকাবিলায় তারা এটাকে হুজুগে পরিনত করতে চাইছে।
ঠিকই ধরেছেন। তবে এটা মানেন তো ক্রাইসিস থেকে উঠে আসা ঈশ্বরেরা আজ হুজুগ। এজন্যই তো বলছি, করুন না একটামাত্র ‘কার ফ্রি ডে’।
সেদিনে কী করবে পরিবহনের সাথে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রমিকেরা?
শ্রমিকটি কোনো দিন প্রাণ ভরে শ্বাস পেয়েছে কিনা জেনেছি? শুধিয়েছি কখনও, সে একদিন উপোষের বিনিময়ে শ্বাসবায়ু চাইছে নাকি? তাকে চুপি চুপি ডেকেছি পায়ে হাঁটার মিছিলে? তাকে বলেই দেখুননা ‘কার ফ্রি ডে’র গল্প।
গাড়ি না হয় চলল না। কিন্তু কারখানা? থার্মাল পাওয়ার প্ল্যাণ্ট? রান্নার উনুন?
ক্লাসে সবাই ফার্স্ট হয়? সেকেণ্ড, থার্ড, ফোর্থ...এরাও থাকে তো। তাইতো একটা দিন শুধুমাত্র আমার-আপনার গাড়ি বন্ধ। ‘কার ফ্রি ডে’।
মা দিবস, বাবা দিবস, পরিবার দিবস, ভালবাসা দিবস- হাঁফিয়ে উঠছি। আর কত দিবস পালন করব?
খাতা, পেন , ক্যালকুলেটর নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হিসেবে বসুন। দেখুন, একটাই দিবস পালন করতে ইচ্ছে করবে - 'কার ফ্রি ডে'।
ভারতের মত গরিব দেশে আশি ভাগ লোকের কোনোরকম মোটরচালিত যান নেই। গাড়ি চাপা তাদের কাছে বিলাসিতা।তারা তো দূষণ ঘটায়নি। এখানে এসব হুজুগের দরকার আছে?
হ্যাঁ, আছে বৈকি। একদিন তাদের মত হেঁটে তাদের স্যালুট করার সুযোগ হারাবেন কেন? তাই তো বলছি, ২২ সেপ্টেম্বর ‘কার ফ্রি ডে’।
সেদিন আমি তো হাঁটছি, আপনি?
Biplab Das 14-09-2019
Photo courtesy: google.com

Wednesday, September 4, 2019

SUNDAY

S  U  N
D  A  Y
রবিবার হলেই হইহই করে সবাই রাজপথে নেমে পড়ে। চলে নাচগান, চলে মুকাভিনয়-নাটক-যোগব্যায়াম-জিমন্যাস্টিক। যতক্ষণ এসব চলে, সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুটো- শহরের ১২০ কিলোমিটার রাজপথে একটিও মোটরগাড়ি চলে না। যারা হাঁটেন তারা তোঁ হাঁটবেনই। বাকিরা সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ান। রাজপথের মসৃন বুকে বালক-বালিকারা কেউ কেউ স্কেট করতে করতে যায়।

‘সাইক্লোভ’। ১৯৭৪ সাল থেকে কলম্বিয়ার বোগোতা শহরের প্রতিটি রবিবার এভাবেই কেটে আসছে। প্রচলিত ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করে একটু অন্যরকম, শুধুমাত্র একটু অন্যভাবে বাঁচতে এবং দূষণহীন কিছুটা সময় কাটানোর জন্য শহরের সাইকেলপ্রেমী যুবকেরা যে পরবের সূত্রপাত করেছিলেন সময়ের সাথে সাথে সেই পরবের ব্যাপ্তি বেড়েছে। মাত্র দু বছরের মাথায়, ১৯৭৬ সালেই এই উৎসবে সরকারি সিলমোহর পড়ে। শহরের বিশাল সংখ্যক জনগণ এতে সামিল হতে থাকেন। শহরবাসীরা সাইক্লোভকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছেন যে, ২০০৭ এ হঠাৎই কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা সাইক্লোভ নিষিদ্ধ করে দেওয়া জন্য আইন আনতে চাইলে গণচাপে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এখন তো শুধুমাত্র রবিবার নয়, অন্যান্য পাবলিক ছুটির দিনেও বোগোতার ওই সব রাস্তায় ধোঁয়াচালিত যান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল হলেই রাস্তায় নেমে পড়েন শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ, সংখ্যায় প্রায় কুড়ি লাখ।

কলম্বিয়ার দেখাদেখি অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্ট-মেলবোর্ণ, আর্জেণ্টিনার রোজারিও, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস, কানাডার উইনিপেগ-ভ্যাঙ্কুভার-হ্যামিলটন-ওটাওয়া-টরেণ্টোতে ‘সাইক্লোভ’ শুরু করা হয়েছিল। কোথাও এখনো চলে, কোথাও পারা যায়নি।

পরীক্ষানিরীক্ষার শেষ নেই। ব্রাজিলে বড় কয়েকটি শহরে রবিবার কয়েকটি রাস্তা শুধুমাত্র পদযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চিলির সাণ্টিয়াগোতে প্রতি রবিবার সকালে ৩২ কিলোমিটার রাস্তা মোটরগাড়ি নিষিদ্ধ। বোগোতার মতই সেখানে সাইকেল, স্কেটিং নিয়ে মানুষ রস্তায় নেমে পড়েন।
কোস্টারিকা, গুয়াতেমালা, মেক্সিকো, পেরু, নিউজিল্যাণ্ড, ইকুয়েডর, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের মানুষ বোগোতার ‘সাইক্লোভ’ মডেল চালু করেছে। জনচাপ প্রশাসনকে নড়াতে পারে- সাইক্লোভ এর উদাহরণ।

ভারতে? হ্যাঁ। ‘রাহগিরি’ নাম দিয়ে গুরগাঁওতে ২০১৩ সালে একটিবার চেষ্টা করা হয়েছিল।

শুধুমাত্র দূষন থেকে বাঁচতে? নাকি ভোগবাদী সমাজ নিজের সংকট থেকে বেরোতে উপায় বের করার চেষ্টা করছে? নিরন্তর মারকাটারি লেগে থাকা অস্থির কলম্বিয়াবাসীরা এরকম আপদে নিয়মকে আপন করে মেনে নিলেন কেন?       

photo courtsey: google.com

আমাজন-আমেরিকা- চিন কঙ্গো

পৃথিবীর দুটি ফুসফুস। বাম ফুসফুসটি দক্ষিণ আমেরিকায়, আমাজনের জঙ্গল। ডানটি আফ্রিকার কঙ্গোতে। ব্রাজিলের প্রেসিডেণ্ট ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, আমাজনকে খনিমালিকদের জন্য  উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। আরও ঘোষণা, সেখানে জঙ্গল কেটে চাষবাস করতেও কোনো বিধি নিষেধ রইল না। যেই না বলা, মার্কিন শিল্পগোষ্ঠীদের নজর চলে গেল উর্বর আমাজনের দিকে।
ওদিকে কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট থেকে লক্ষ লক্ষ চিরহরিৎ বৃক্ষ কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিনে। চিন আমেরিকার জন্য সস্তার আসবাবপত্র বানিয়ে দেয়। তার প্রায় পুরোটাই এখন কঙ্গোর অরণ্য থেকে সরবরাহ হয়।
শক্তিধর দেশগুলির নজর আফ্রিকায়। অসাম্য-দূর্নীতি-গহযুদ্ধ-অস্থিরতা লেগে থাকা দেশগুলির দিকে। যেখানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ খুবই কম, থাকলেও সেখানে কিছু খুচরো পয়সা ছড়ালেই সবাইকে কেনা যায়। সরাসরি ব্যবসায় অসুবিধে হলে যে কোনো একটি স্থানীয় সংস্থা কে শিখণ্ডি রূপে দাঁড় করিয়ে দিলেই হল।
শেষ কয়েক বছরে কঙ্গো থেকে চিনে যাওয়া কাঠের পরিমান প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। চিন নিয়ে যাচ্ছে একেবারে গোল গোল কাঠের লগ। গাছ কাটা হচ্ছে মেশিনে। কাঠ কাটা, চেরাই কোনোটাই কঙ্গোতে হচ্ছে না। চিনের কাঠ ব্যবসায়  কঙ্গোর স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবুও স্থানীয় জোরদার প্রতিবাদ নেই। কেন?
উত্তর পাবেন এখানে। ছত্তিশগড়ে পারসায়, ঝাড়খণ্ডে পশ্চিম সিংভুমে, পুরুলিয়ার অযোধ্যায়। কোন কৌশলে জল-জঙ্গল-জমিকে  বৃহৎ পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া যায় তার রোল মডেল ভারত, নেহেরুর আমল থেকেই।

Biplab Das 20-04-19
Photo courtesy:  google.com

এক দুপুর খিদে

মহিলা হাত বাড়িয়ে দেখালো,  লম্বা,  সরু,  এক-মোচড় দেওয়া লেড়ো বিস্কুটের দিকে। দোকানি একবার প্লাটফর্মে বসে থাকা লোকটি আরেকবার মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনটে বিস্কুট বের করল। মহিলার কোলে একটা ধেড়ে বাচ্চা। সে দুমড়ে মুচড়ে শরীরটাকে স্থির করতে চেষ্টা করছে,  লেড়ো বিস্কুটের মতো।

মহিলার পায়ের কাছে প্লাটফর্মে বসে থাকা লোকটির কোনো নেশা নেই,  দাঁত দেখেই বোঝা যায়,  ঝকঝকে,  দাঁতে করে কামড়ে মুখ ভর্তি লেড়োর পেষ্ট বানিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে এ গাল আর ও গাল করছে। ছেলেটিকে কোল থেকে নামাতেই বোঝা যায়,  স্পেশাল চাইল্ড। প্রথমেই শুয়ে পড়েছে নোংরা প্লাটফর্মে। তারপর নখ দিয়ে আঁচড় কেটে কেটে কী যেন আঁকতে যায়।  বাঁ হাতের বিস্কুটটা মুখে পুরতে পারছে না। মা বোঝে।

মা বোঝে এক দুপুর খিদে নিয়ে বাচ্চার কী হয়। নিজের বিস্কুট মুখে চালান করে বাচ্চাকে তার বিস্কুটটি একটু করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেয়। মহিলার হাত যখন কাজ করে,  চোখ তখন ব্যস্ত উল্টো দিকের প্লাটফর্মে, হলুদ রঙের খোঁজে। হঠাৎ, এক অদ্ভুত গোঙানি শুনে সচকিত মহিলা দোকানির দিকে তাকিয়ে বলে, "একটু চা দিবেন?"

চা দিতে গিয়ে দোকানি বোঝে লোকটি অন্ধ। স্মৃতিতে স্বাদ আছে, রঙ নেই। ওদিকে ধেড়েটি ফের কোলে উঠে মায়ের  ব্লাউজের হুক ধরে টানাটানি শুরু করেছে। মহিলার একটা হাত ছেলেকে আটকাতে ব্যস্ত, মহিলার শরীর ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে অন্ধ ব্যক্তি,  মহিলার চোখে ট্রেন মিস করার আশঙ্কা, এসময়ে দোকানি বলে উঠলো, “ তিন দুয়ে ছয় আর চার মিলে দশ টাকা। “

পয়সা?  সে তো সারের বস্তা কাটা থলির ভিতরে।  ওদিকে একটা ট্রেন ঢুকছে।  গেটের কাছে বাবুটি বলে দিয়েছিল  একটু পরেই ওদিকে দিয়ে আসবে হলুদ ট্রেন।  এটা হলুদ তো?  সে অন্ধ নয়,  তাই রক্ষে।

একটা থালা-বাটি ,  দুটো ন্যাকড়া,  ছোটো গামছা একটি,  একটা দাঁতন,  দুটো প্রেসক্রিপশন,  একটি শিশি,  ওষুধের পাতা বেরোনোর পর বেরোলো একটি প্যারাশুট নারকেল তেলের বড়ো মুখওয়ালা কৌটো। সেখান থেকে দশ টাকার নোট বের করে ফের সবগুলো থলিতে ঢোকাতে ঢোকাতে ছেলেটি ওর ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বাম স্তনটি বের করে ফেলেছে। পিছনে পিঠ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। একটি উন্মুক্ত স্তন নিয়ে দোকানির টাকা চুকিয়ে থলি হাতে মহিলা জোর পায়ে হাঁটতে থাকে হলুদ রঙের ট্রেনের দিকে। কোলে ছেলে,  পিঠে হাত দিয়ে তাকে ছুঁয়ে ছুটছে লোকটি, তার বর নিশ্চয়। মুক্ত স্তন, একদম শুকনো, ভারহীন, পাখির পালকের মতো।

স্তন জোরে জোরে নড়ছে,  ট্রেনটিও একটু নড়ে উঠলো যেন।  স্তন মুখে পোরার সুযোগ পাচ্ছে না,  বাচ্চাটির গলা ফাটা চিৎকার ট্রেনের হুইশলকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। এখনও অনেকটা বাকি। তিনজন তিনজনকে স্পর্শ করে ছুটছে একটা বৃহৎ শরীরের মতো। যে শরীরে তিনটে মুখ, তিনটে পেট, তিনটে পায়ু, ছটা পা,  দুটো চোখ,  একটা মাথা, দুটো হাত......

Biplab Das
18-06-19

কাঁংড়ি : মৃতদেহ নিয়ে বাস করি

কাঁংড়ি -  ৬ #মৃতদেহনিয়েবাসকরি#
জামশেদপুরে জলের টানাটানি। ডিমনার জলে ই বছ্যর ঢল নাই। মানগো বস্তির উপর দিকের ঘরগুঁল্যাতে তিন ঘরে একটা চান ঘর। জল উঠ্যে কুঁয়া থ্যাকে, শুকায়্যেঁ পাথর বেরাঁই গ্যেছে ই বছর। তাই কাংড়িও বৌ বাচ্চা লিয়্যেঁ আস্যে গ্যেছে চাইবাসা।

রোরো কথা রাখে। রোরো লদীও আবার মানুষও। বালি বালি গরম্যে রোরো-র গা ঘামে। তির তির করে জল নামে। সেই ঘামে মোটা খড় ফিটিং করে দিল্যেঁই  'কল'। এক ঘটি দু মিনিটে। ঘন্টায় পাঁচ বালতি। বউ কে কাঁংড়ি  বলল্য, "ল্যে, যত মন করে জল খা, হাত ধু, পা ধু, কাপড় কাচ,  চান কর।"
শ্বশুর ট বড় মুখ খারাপ করছ্যেঁ সকাল থ্যেকে। উ খালি বলছ্যে, "ব্যালেন্স রাখহ হে জামাই। শুধু মরাগুল্যাকে লিয়ে কদিন বাঁইচব্যে?"
শ্বশুর একবার তাড়ি খায়্যেঁ ভুল বকা শুরু করল্যে চুপানো দায়। বেশি বলত্যে গেলে দা লিয়্যেঁ ছ্যুটে আসে।
ইব্যারে বলছ্যেঁ, "শুধু মরাগুল্যা লিয়ে কি করে বাঁচঅ বাপ?"
কাঁংড়ি সাহস করে শুধায়, " কে মরা?  আমি মরা?  তুমার বিটি, তুমার লাতি মরা? উয়াদের লিয়্যেঁই ত আছি।"

 শ্বশুরের মেজাজ আবার টঙে, "মরা নাই? তর শহরে খাট টেবিল চেয়ার দরোজা সব ত ডেডবডি রে। জামা-কাপড়, বই, খাতা, পেনসিল -সবকটাই মরা। পাহাড় কাট্যে তর ঘরের দ্যায়াল-ছাদ-মেঝ্যা। মরা গাছ, মরা পাহাড়, মরা মাটি। এত পাপ, এত পাপ। তর মরার সময় মুখে জলটুকুও কেউ দিতে আসব্যেক নাই। আমাদের ইখ্যানে থাক। খাটিয়া আছ্যে বঠ্যে আবার চারট্যা ছাগল আছ্যে। একটা হুড়কা আছে ত, ভুলা টঁকেও পুষ্যেছি। মাটির দ্যায়াল যেমন আছে, একটা ডবা আর পাড় ভত্তি বনও ত আছে। দ্যাখ আমি ম্যারেছিঁ,  জীবনও দিছিঁ। ব্যালেন্স রাখ বাপ, ব্যালেন্স"।

স্কুলে বৃক্ষরোপণ।

স্কুলে বৃক্ষরোপণ।
অসহ্য গরম। মেঘলা আকাশ। জনা কুড়ি বাচ্চা। এক শিক্ষক। হইচই, খুনসুটি, ঠেলাঠেলি- তারই মাঝে কাজ।
একটা পাকুড় আর একটা শিরিষ পোঁতার পর দেবদারুটি পোঁতার তোড়জোড় চলছে।
টিপটিপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে কয়েকজন ছাত্র চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়।
এক ছাত্র: সার, জল পড়ছে। 
শিক্ষক: হুম। তোদের বলেছিলাম না, গাছের জন্যি বৃষ্টি হয়। দ্যাখ, গাছ লাগালি, আর অমনি বৃষ্টি শুরু হল। যখন যখন দেখবি বৃষ্টি পড়ছে, আসলে তখন তখন কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও গাছ লাগাচ্ছে। বুঝলি ?
ছাত্ররা দু হাত দিয়ে মুখে বৃষ্টির ফোঁটা মাখছে।
ঠিক তখনই কেউ স্কুলের ছাদে উঠলে দেখতে পেত শুকনো দীঘির পিছনের মাঠ দিয়ে ধোঁয়া উঠিয়ে ধেয়ে আসছে বর্ষা ঋতু।

ফার্স্ট বয় ফার্স্ট গার্লরা প্রাথমিক শিক্ষক হতে চায় কি?

ফার্স্ট বয় ফার্স্ট গার্লরা প্রাথমিক শিক্ষক হতে চায় কি?
কে ভালো, কে খারাপ, কী ঘটে, কে ফাঁকিবাজ- সে নিয়ে তো হরদম লড়ে যাচ্ছি। এখন বরং আলোচনা করি কী হওয়া উচিত, সে নিয়ে। এই আলোচনাটি হাইপোথিটিক্যাল। এখানে পশ্চিমবঙ্গ-ভারত, কেন্দ্র-রাজ্য, চাকরি পাওয়া- না পাওয়া, সরকারি-বেসরকারি, আমি-তুমি, ব্যক্তিগত সেন্টিমেণ্টের কোনো জায়গা নেই।
ক্লাসের ভালো লেখাপড়ার ছেলেরা চলে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং , ডাক্তারিতে। মনপসন্দ রোজগার সেখানে। যারা পড়ে থাকে জেনারেল কলেজে ভর্তি হয়। অল্প স্বল্প কলেজ পড়ে হয় সাধারন চাকুরে, একটু বেশিদিন ধরে ধৈর্য্য নিয়ে পড়লে হাইস্কুল শিক্ষক, আরও একটু বেশি সময় নিয়ে পড়লে অধ্যাপক। মোটামুটি এটিই সিনারিও। এখানে কোনো ব্যতিক্রমের প্রসঙ্গ টানছি না। কারন ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। তা সে যতই উজ্জ্বল হোক বা অনুজ্জ্বল।
যাই হোক। এবার পড়ে রইল এমন একটা অংশ যারা এটার মধ্যে পড়ছে না, কিম্বা যারা নানারকম ডিগ্রির পরেও কোনও কারনবশত অন্যান্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন চাকরি খুঁজতে থাকে। কেউ ব্যবসা শুরু করে। এই সব খুঁজতে থাকা মানুষের একটা বড়ো অংশ প্রাথমিক শিক্ষকতায় যোগ দেয়। তাদের অনেকে হয়তো ইতিমধ্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে ফেলেছে।
একজন প্রাথমিক শিক্ষক কত বেতন পান?
মোটামুটি বলা যায়, সরকারি বেতনভুক মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে নীচের দিকে। আর সমস্ত শিক্ষক কূলের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তার কাজটি কী?
প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পরিবেশ থেকে উঠে আসা, বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক গঠন সম্পন্ন শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের পাঠদান। দুটি ভিন্ন বাড়ি থেকে আগত শিশুর মধ্যে আসমান জমিন স্বভাবগত পার্থক্য থাকে। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষককে একই সাথে কয়েকঘণ্টার জন্য ছাত্রের খাওয়াদাওয়া, হাগু-মুতু, শরীর, কান্না-হাসি, মারামারি, মান-অভিমান - এসবের দ্বায়িত্ব নিতে হয়। যে দ্বায়িত্বের গুণগত মান শিশু ছাত্রের ভবিষ্যতের চরিত্র নির্ধারণ করে। ( ভারতের মত দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের আরও কিছু অতিরিক্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে হয়, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না)
একটি রুমের মধ্যে একজন মাত্র প্রাথমিক শিক্ষকের কাছে অনেক সময় সব ক্লাসের ছাত্ররা সব বিষয়গুলি একসাথে পড়ে। সত্যি বলতে কী, এই কাজটিতে যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন। হয়তো একজন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়েও বেশি। কারন বড় ছাত্রদের পড়ানোর ঝামেলা কম। দায়িত্ব অপেক্ষাকৃত কম। যিনি ইতিহাস বা জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন, তিনি কাদের পাচ্ছেন? যারা ইতিমধ্যেই কয়েকটা ক্লাস টপকে এসেছে, পড়াশোনার সাথে অভ্যস্ত। আরও সুবিধে হল, সেই ছাত্ররা ইতিহাস ক্লাসে ইতিহাসের জন্যই মনোসংযোগ করতে পারে। কলেজের অধ্যাপকদের কাজটি আরও সহজ। তারা এমন একটি ছাত্রদলকে পায় যারা সেই নির্দিষ্ট বিষয়টির জন্য ইতিমধ্যেই জ্ঞানী বা জ্ঞান লাভ করতে উৎসাহী।
তাই ডিগ্রির ব্যাপারটা একটুক্ষণের জন্য সরিয়ে রাখলে এটাই দাঁড়াবে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিৎ সবচেয়ে বেশি। সমস্ত পেশার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষক দরকার। অনেক বছর ধরে অনেক কিছু পড়াশোনা করা বিশাল কিছু জ্ঞানীগুণী না হলেও চলবে। সত্যি বলতে কী, কোনো একটি ব্যাচের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষাদানে আকর্ষিত করা দরকার। দশ ক্লাস বা বারো ক্লাসের পর একটা জবরদস্ত এন্ট্রান্স। এন্ট্রান্সে পেলে বছর পাঁচের ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষে সর্বোচ্চ বেতনের নিশ্চিত চাকরি- 'প্রাথমিক শিক্ষক'। সব দেশে, সব প্রদেশে, সব যুগেই এটি হওয়া উচিৎ।
(এ সিস্টেমে চললে আরও একটা মজাদার ব্যাপার ঘটার সম্ভাবনা আছে। তখন কতকগুলো ঘরকুনো, স্বার্থপর, ছায়া প্রকাশণীর মডেল ক্লাসে ফার্স্ট নাও হতে পারে। পুরো হিসেব উল্টে যেতে পারে।)
বিঃদ্রঃ আমি প্রাথমিক শিক্ষক নই। আমার চোদ্দপুরুষের কেউ ছিলেননা। আমি আবার একদমই বেশি ডিগ্রিধারী নই। এই রচনাটি আজ থেকে দশ বছর আগে আমার অশিক্ষক বন্ধুদের সাথে আড্ডার নির্যাস।
Biplab Das
26-07-19

রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ

১৮২৫ থেকে ১৮৫০। মাত্র ২৫ বছরের একটা উল্লম্ব লাফ।
খুব সহজে এর একটা সূচনাবিন্দু ধরা যেতে পারে। ১৮১৫। যে বছরে রামমোহন রায় স্থায়িভাবে কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর জীবনের আসল কাজগুলি গুরুত্ব সহকারে হাত দেন। বলা যেতে পারে তিনিই এই লাফের অবিসংবাদী ‘রান-আপ’।
একজন ইউরোপিয়ান শিক্ষক বাঙালীদের মনে করাচ্ছিলেন তোমরা তো একসময় তর্কশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলে। তিনি তরুণ হওয়ার আগেই লিখে ফেলেছিলেন ‘ফকির ওফ ঝুঙ্গিরা’। তাঁর ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক চলত। তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যতের বাঙালি যতই বিতর্ক করুক না কেন তিনি যদি হিন্দু কলেজের চুম্বক না হতেন হয়ত আমরা আজ অনেক কিছুই দেখতে পেতাম না, এখনও আর্যাবর্ত বা মুঘলাই ঘুর্ণি তে পাক খেতাম। তিনি হেনরি ভিভিয়ান লুইস ডিরোজিও। ভুল। ইয়ংবেঙ্গল হয়তো অনেক ভুল করেছিল। কিন্তু ভুল যে অনেক সময় ঠিকের চেয়েও মূল্যবান। প্রমান গত শতকের সাতের দশক।
ভাবা যায়, টোল পণ্ডিতির যুগে দুটো পত্রিকা বেরোচ্ছে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ এবং ‘এনক্যোয়ারার’।
১৮৩৩ এ নতুন চাটার্ড অ্যাক্টে ভারতীয়দের জন্য উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির বাজার খুলে গেলে ডিরোজিয়ানরা আরও মারাত্মক ভাবে মিশে গেলেন সমাজে, সমাজের ভালোমন্দে। হয় মুভমেণ্টে, নয় রিফর্মে। যার ফলে ১৮৪২ থেকে বেরোতে শুরু হল ‘বেঙ্গলি স্পেক্টেটর’। হ্যাঁ, বাঙালি যা ভাবত, ঘোমটা আর পাগড়িতে আটকে থাকা ভারত তখনো সেসব ভাবেনি।
বাঙালি ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষ। ব্রিটিশদেরও স্থানীয় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সমর্থনে লিখে ফেললেন ‘রিমার্কস অন দ্য ব্ল্যাক অ্যাক্টস’। তিনি বেচু চাটুজ্জ্যে স্ট্রিটে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলে চেতলা বাজার থেকে লোক ছুটে আসত তাকে দেখতে।
প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার- ডিরোজিওর দুই প্রিয় শিষ্য অনেকগুলি বুদুবুদকে এক করে গড়ে তুললেন ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। তাদেরই ‘মাসিক পত্রিকা’য় বাংলা গদ্য সংস্কৃত-মুক্ত হল। তারা মাপছিলেন। বাঙ্গালির নেওয়ার ক্ষমতা মাপছিলেন। বাঙ্গালিও নিতে নিতে পরপর নক্ষত্র প্রসব করতে লাগল। প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক, পরে পরে রাজনৈতিক নক্ষত্র। সশব্দে বা নিঃশব্দে তারা জ্বলতেন।
তারাচাঁদ চক্রবর্তী। যাকে আমরা প্রায় কেউ চিনব না। বইএর পাতার কোনো এক লাইনে যিনি দুটো কমার মধ্যে রয়ে যাবেন, তিনি ইয়ংবেঙ্গলের নিঃশব্দ নেতা।
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়? সবাই তো কুৎসা নিতে পারেন না। তিনিও পারেননি। ঐ বাংলা তাঁকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছিল উত্তরপ্রদেশে। কিম্বা সেই অনামী ডিরোজিয়ান, যিনি সন্নাসী হয়ে কাথিয়াওয়াড় চলে গেলেন, স্থানীয় রাজবিদ্রোহে অংশ নিলেন। তাকেও ঐ বাংলা মেনে নেয়নি।
অনেকেই পালিয়ে যাননি, শুধু লড়ে গেছেন, সমালোচিত হতে হতে। আর এঁরা সবাই, এঁদের সাথে রামতনু লাহিড়ি, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অক্ষয়কুমার দত্তরা যে অভাবনয়ীয় র‍্যাডিকেল রাজনীতির বীজ বুনে ফেলেছিলেন আজ তাকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করে দিতে পারি বটে কিন্তু তার অনুভব অস্বীকার করতে পারিনা।
এদের নিয়েই বহু বছর আগে, ১৯০৩ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখে গেছেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’।
বাঙালিকে জানতে যা পড়তেই হবে।

আমাজন ও ভারতের গল্প

যেমন করে গর্ত থেকে পিঁপড়ে বেরোয় বা মৌচাকে ঢিল পড়লে মৌমাছি, সেরকমই জঙ্গল থেকে পিল পিল করে লোক বেরোচ্ছে। আধা উলঙ্গ জংলি। ছেলে কোলে নিয়ে মায়েরা উর্ধশ্বাসে দৌড়োচ্ছে বড় রাস্তার দিকে। হাঁফিয়ে পড়ার জো নেই। পিছনে ফেলে এসেছে আদিম বাড়িঘর-পাথরের পাত্র-আঁশ ছাড়ানোর ঝিনুক।
হারু মিস্ত্রি। শুধু নামে নয়। পেশাতেও। ঘর ছাওয়ার কাজ করে সে।
দাদু খুব নাম-ডাকওয়ালা ছিল। বসন্ত-গ্রীষ্মে তিনমাস ঘরে ফেরার সময় পেতনা। কাছাকাছি কোথাও হলে হারুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত।
বাবার সাথে হারু রোজই কাজে যেত। বাবা দশ কী কুড়ি ফুট উপরে উঠে কাজ করত। উঠোনে আঁটি বাধতে বাঁধতে হারু বই পড়ত। সামনে তখন মাধ্যমিক। হারুর পছন্দের বিষয় আবার ভুগোল। বাবা ওপর থেকে প্রায়ই চ্যাঁচাত, ‘দ্যাখত হারু, আড়ির কাঠটা সোজা হয়েছে কিনা’। বাবা বলার সাথে সাথে হারুকে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে হত। ওপরের দিকে তাকিয়ে বলত, ‘ঠিক আছে’। ওদিকে উঠোনে ফেলে আসা বইয়ের পাতাগুলি হাওয়ায় উড়তে উড়তে একটা ওল্টানো ‘ব’ এর মানচিত্রে আটকে যেত। দক্ষিন আমেরিকা। বিপিন স্যার একদিন একটা ঢাউস রঙ্গীন বই দেখিয়েছে, ‘ব’ এর পেটটা পুরো সবুজ।
ওপর থেকে বাবা মাঝে মাঝেই ঝাঁঝিয়ে উঠত, ‘এগুলো খড় না বাল। চাষ করছে সব। ইংরিজিতে ধানের নাম। বলি, শুধু ভাত খেলেই হবে? গরুকে খেতে দিতি হবে না। ঘর ছাইতি হবে না? খড় কই, খড়? ভালো করে পড় বাপ। এ কাজে আর জুত নাই। সব শেষ। তোকে কেন জন্ম দিতে গেলাম। সন্তান আনা পাপ। আর কত কী দেখতি হবে কে জানে’। দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বাবা কথাগুলো বলত। কে জানে, উঁচুতে উঠে থাকত বলে বাবা হয়ত আরও বেশি কিছু দেখতে পেত।
জঙ্গলের মধ্যেও ছোট ছোট দেশ থাকে। নদী দিয়ে ঘেরা থাকে সেসব দেশের সীমানা। পুরুস, রিও-পৌনি, কুরুদরি- এসব নদীর নাম। নদীর মন মর্জিতে সীমানা পালটে যায় বারে বারে। সব সীমানা পেরিয়ে সব দেশগুলো এখন অন্য এক পৃথিবীর রাজপথে দৌড়ে যাচ্ছে। দেশে পড়ে আছে অসংখ্য ম্যাকাউ, টুকান, ক্যাপিবারা, জাগুয়ার।
দিগন্ত দেখতে দেখতে একদিন বাবা ওপর থেকে ধপ করে পড়ে গেল। নিচে আলগোছে পড়ে থাকা ভাঙ্গা জোয়ালের একটা অংশ ভস করে গেঁথে গেল পেটে। বাবার আধমরা শরীরটা আর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে হারু রিকশাভ্যানে করে গিয়েছিল হাসপাতালে। জীবনের দীর্ঘতম যাত্রা।
বহুবার, বহুবার আগুন নিভিয়েছে সে। গ্রামে কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে হারু ছুটে যায়, চালায় ওঠে, ভেঙ্গে দেয় খড়ের ছাদ। দাউ দাউ আগুনের মধ্যে বাড়ির নাড়িভুঁড়ি বের করতে করতে বারবার বাবার কথা মনে পড়ে।
এখন আর ঘর ছাওয়ার কাজ সেরকম আসেনা। রাজমিস্ত্রির সাথে মশলা বইতে মন চায় না। কোনো কোনো দিন চাল মিলে বস্তা বওয়ার কাজ করে। দুটো বাচ্চা, একটা বউ।
বেরোনোর পর এক এক করে গুনলে দেখা যেত প্রায় দশ লক্ষ লোক জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে। পিছনে দাউ দাউ করে জ্বলছে একটা সবুজ রঙ। আমাজন।
হারু চালমিলের টিভিতে বসে বসে কদিন ধরেই আগুন দেখছে, দেখছে বিপিন স্যারের বইতে আগুন লেগেছে। রঙ্গীন মোটা মোটা পাতাগুলি গলে গলে পড়ে যাচ্ছে। বাবা কি ওপরে বসে বসে এসবই দেখতে পেত?
আজ ভোরে হারু বেরিয়েছে। আকাশের তারা দেখে দেখে পশ্চিম বরাবর হাঁটছে। বউটাকে বিছানায় চিরতরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। ঘুমন্ত বাচ্চাদুটো বাড়ির পিছনের ডোবার পাড়ে ঘাসের তিন হাত নিচে আরামে ঘুমোচ্ছে। আরও আরও অনেকটা যেতে হবে তাকে। কয়েক হাজার মাইল। যত পশ্চিমে যায়, পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে ঘনীভূত হয়।
Biplab Das
24-08-2019