Wednesday, September 4, 2019

আমাজন ও ভারতের গল্প

যেমন করে গর্ত থেকে পিঁপড়ে বেরোয় বা মৌচাকে ঢিল পড়লে মৌমাছি, সেরকমই জঙ্গল থেকে পিল পিল করে লোক বেরোচ্ছে। আধা উলঙ্গ জংলি। ছেলে কোলে নিয়ে মায়েরা উর্ধশ্বাসে দৌড়োচ্ছে বড় রাস্তার দিকে। হাঁফিয়ে পড়ার জো নেই। পিছনে ফেলে এসেছে আদিম বাড়িঘর-পাথরের পাত্র-আঁশ ছাড়ানোর ঝিনুক।
হারু মিস্ত্রি। শুধু নামে নয়। পেশাতেও। ঘর ছাওয়ার কাজ করে সে।
দাদু খুব নাম-ডাকওয়ালা ছিল। বসন্ত-গ্রীষ্মে তিনমাস ঘরে ফেরার সময় পেতনা। কাছাকাছি কোথাও হলে হারুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত।
বাবার সাথে হারু রোজই কাজে যেত। বাবা দশ কী কুড়ি ফুট উপরে উঠে কাজ করত। উঠোনে আঁটি বাধতে বাঁধতে হারু বই পড়ত। সামনে তখন মাধ্যমিক। হারুর পছন্দের বিষয় আবার ভুগোল। বাবা ওপর থেকে প্রায়ই চ্যাঁচাত, ‘দ্যাখত হারু, আড়ির কাঠটা সোজা হয়েছে কিনা’। বাবা বলার সাথে সাথে হারুকে ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে হত। ওপরের দিকে তাকিয়ে বলত, ‘ঠিক আছে’। ওদিকে উঠোনে ফেলে আসা বইয়ের পাতাগুলি হাওয়ায় উড়তে উড়তে একটা ওল্টানো ‘ব’ এর মানচিত্রে আটকে যেত। দক্ষিন আমেরিকা। বিপিন স্যার একদিন একটা ঢাউস রঙ্গীন বই দেখিয়েছে, ‘ব’ এর পেটটা পুরো সবুজ।
ওপর থেকে বাবা মাঝে মাঝেই ঝাঁঝিয়ে উঠত, ‘এগুলো খড় না বাল। চাষ করছে সব। ইংরিজিতে ধানের নাম। বলি, শুধু ভাত খেলেই হবে? গরুকে খেতে দিতি হবে না। ঘর ছাইতি হবে না? খড় কই, খড়? ভালো করে পড় বাপ। এ কাজে আর জুত নাই। সব শেষ। তোকে কেন জন্ম দিতে গেলাম। সন্তান আনা পাপ। আর কত কী দেখতি হবে কে জানে’। দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বাবা কথাগুলো বলত। কে জানে, উঁচুতে উঠে থাকত বলে বাবা হয়ত আরও বেশি কিছু দেখতে পেত।
জঙ্গলের মধ্যেও ছোট ছোট দেশ থাকে। নদী দিয়ে ঘেরা থাকে সেসব দেশের সীমানা। পুরুস, রিও-পৌনি, কুরুদরি- এসব নদীর নাম। নদীর মন মর্জিতে সীমানা পালটে যায় বারে বারে। সব সীমানা পেরিয়ে সব দেশগুলো এখন অন্য এক পৃথিবীর রাজপথে দৌড়ে যাচ্ছে। দেশে পড়ে আছে অসংখ্য ম্যাকাউ, টুকান, ক্যাপিবারা, জাগুয়ার।
দিগন্ত দেখতে দেখতে একদিন বাবা ওপর থেকে ধপ করে পড়ে গেল। নিচে আলগোছে পড়ে থাকা ভাঙ্গা জোয়ালের একটা অংশ ভস করে গেঁথে গেল পেটে। বাবার আধমরা শরীরটা আর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে হারু রিকশাভ্যানে করে গিয়েছিল হাসপাতালে। জীবনের দীর্ঘতম যাত্রা।
বহুবার, বহুবার আগুন নিভিয়েছে সে। গ্রামে কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে হারু ছুটে যায়, চালায় ওঠে, ভেঙ্গে দেয় খড়ের ছাদ। দাউ দাউ আগুনের মধ্যে বাড়ির নাড়িভুঁড়ি বের করতে করতে বারবার বাবার কথা মনে পড়ে।
এখন আর ঘর ছাওয়ার কাজ সেরকম আসেনা। রাজমিস্ত্রির সাথে মশলা বইতে মন চায় না। কোনো কোনো দিন চাল মিলে বস্তা বওয়ার কাজ করে। দুটো বাচ্চা, একটা বউ।
বেরোনোর পর এক এক করে গুনলে দেখা যেত প্রায় দশ লক্ষ লোক জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে। পিছনে দাউ দাউ করে জ্বলছে একটা সবুজ রঙ। আমাজন।
হারু চালমিলের টিভিতে বসে বসে কদিন ধরেই আগুন দেখছে, দেখছে বিপিন স্যারের বইতে আগুন লেগেছে। রঙ্গীন মোটা মোটা পাতাগুলি গলে গলে পড়ে যাচ্ছে। বাবা কি ওপরে বসে বসে এসবই দেখতে পেত?
আজ ভোরে হারু বেরিয়েছে। আকাশের তারা দেখে দেখে পশ্চিম বরাবর হাঁটছে। বউটাকে বিছানায় চিরতরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। ঘুমন্ত বাচ্চাদুটো বাড়ির পিছনের ডোবার পাড়ে ঘাসের তিন হাত নিচে আরামে ঘুমোচ্ছে। আরও আরও অনেকটা যেতে হবে তাকে। কয়েক হাজার মাইল। যত পশ্চিমে যায়, পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে ঘনীভূত হয়।
Biplab Das
24-08-2019

No comments: